শফিউল আযম, বেড়া ( পাবনা) সংবাদদাতা ঃ
চলনবিল মানেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে হরেক প্রজাতির পরিযায়ী পাখি আর মাছের সমারোহ। একই সঙ্গে বছরজুড়ে দেশি প্রজাতির পাখিদের নিত্য আনাগোনা। মাছ-পাখির পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী চলনবিল আরো একটি কারণে পর্যটকদের আকর্ষণ করছে। বর্ষা-শরৎ ও হেমন্ত মওসুমে বিলজুড়ে ফোটে নানা প্রজাতির শাপলা ফুল ও গুল্মলতা। এরমধ্যে নয়নাভিরাম মনোমুগ্ধকর লাল ও বেগুণী শাপলা ফুলের আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি। বর্ষা মওসুমে বিল-নদীতে প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয় শাপলা। আবহমান কাল থেকেই শাপলা মানুষের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভূক্ত ছিল। গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারে পাওয়া যেত শাপলা ফুলের মধু (পদ্ম মধু) শালুক আর ঢেপের খইয়ের মোয়া। চলনবিলাঞ্চলের স্বল্প আয়ের অভাবী মানুষ বিল থেকে পদ্ম মধু, শাপলা-শালুক ও মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। এখন শুকনো মওসুমে বিল-নদী-জোলা শুকিয়ে যাওয়ায় চলনবিল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নানা প্রজাতির শাপলা, গুল্মলতা, মাছ ও জলজপ্রাণী । ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বিল ও নদীর জীবনচক্র।
‘ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া’ বই থেকে জানা যায়, এক সময় চলনবিল নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, নওগাঁ জেলার রানীনগর, আত্রাই, সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, বেড়া এবং বগুড়া জেলার দক্ষিণাঞ্চল মিলে চলনবিলের অবস্থান ছিল। ১৯৬৭ সালে এমএ হামিদ টি,কে ‘চলনবিলের ইতিকথা’ বইতে লিখেছেন, তখন থেকে প্রায় ১৪০ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৮২৭ সালে জনবসতি এলাকা বাদ দিয়ে চলনবিলের জলময় অংশের আয়তন ছিল ৫০০ বর্গমাইলের উপরে। ১৯০৯ সালে চলনবিল জরিপ কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, তৎকালে বিলের আয়তন ছিল ১৪২ বর্গমাইল। এর মধ্যে ৩৩ বর্গমাইল এলাকায় সারা বছর পানি জমে থাকতো। ওই রিপোর্টে বলা হয়, চলনবিল তার পানির স্রোতধারা ও নাব্যতা হারিয়ে ক্রমশঃ সংকুচিত হচ্ছে।
প্রাপ্ত তথ্য সূত্রে জানা যায়, গঠণকালে চলনবিলে মোট প্রায় এক হাজার ৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল, চার হাজার ২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট ২২টি খাল রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে বর্ষা মওসুমে আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ৩৬৮ বর্গকিলোমিটার। শুষ্ক মওসুমে (মূল বিলটি) আয়তন দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৯ থেকে ৩১ দশমিক ০ কিলোমিটার। এছাড়া বিলের গভীরতা এক দশমিক ৫৩ মিটার থেকে এক দশমিক ৮৩ মিটার; সর্বোচ্চ প্রশস্ততা ১৩ কিলোমিটার এবং সর্বোচ্চ দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪ কিলোমিটার।
জানা যায়, কয়েক বছর আগেও চলনবিলের ছয়আনিবিল, বাঁইড়ারবিল, সাধুগাড়ীবিল, সাঁতৈলবিল, কুড়ালিয়াবিল, ঝাকড়ারবিল, কচুগাড়ীবিল, চাতরারবিল, নিহলগাড়ীবিল, চেচুয়াবিল, টেঙ্গরগাড়িবিল, খোলারবিল, কুমীরাগাড়িবিল, খৈগাড়িবিল, বৃগরিলাবিল, দিগদাড়িয়াবিল, খুলুগাড়িবিল, কচিয়ারবিল, কাশীয়ারবিল, ধলারবিল, ধরইলবিল, আমদাকুরীবিল, বাঙ্গাজালী বিল, হুলহুলিয়া বিল, কালামকুরীবিল, রঘুকদমা বিল, কুমীরা বিল, বোয়ালিয়া বিল, হরিবিল, বুড়িবিল, রহুয়াবিল, সোনাডাঙ্গা বিল, কাতলবিল, বাঘমারা বিল, চিরলবিল, ডিকশীবিল, রুখলী ডাঙ্গাবিল, পাতিয়াবিল, চিনাডাঙ্গী, আইড়মারীবিল, কৈখোলাবিল, কানচগাড়ীবিল, গলিয়া বিল, চিনাডাঙ্গাবিল, মেরীগাছাবিল, খলিশাগাড়ীর বিল, পাওয়া যেত নানা প্রজাতির প্রচুর শাপলা ফুল।
এছাড়া চলনবিলের আত্রাই, গুড়, করতোয়া, ফুলঝোর, বড়াল, মরা বড়াল, তুলসী, চেঁচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা, তেলকুপী (মরা আত্রাই), নবী হাজীর জোলা, হক সাহেবের খাল, নিয়ামত খাল, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধর, পানাউল্লার খাল, নিমাইচরা-বেশানী খাল, বেশানী-গুমানী খাল, উলিপুর-মাগুড়া খাল, দোবিলা খাল, বাঁকাই খাড়ি, গোহালা নদী, গাঁড়াবাড়ী-ছারুখালী খাল, বিলসূর্য নদী, কুমারডাঙ্গা নদী, জানিগাছার জোলা, বেহুলার খাড়িতে এখনো নানা রঙের শাপলার অপরুপ দৃশ্য দেখা যায়। শুকনো মওসুমে বিল-নদী-জোলা শুকিয়ে যাওয়ায় চলনবিল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নানা প্রজাতির শাপলা গুল্মলতা ও জলজপ্রাণী । ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বিল ও নদীর জীবনচক্র।
বিলের পানিতে ভাসছে শত শত পাখির ঝাঁক। স্থানীয় মানুষের মতে, এবার চলনবিলে বালিহাঁস, ভূতিহাঁস, গিরিয়া হাঁস, ল্যাঞ্জা হাঁস, সনালি, গুটি ঈগল, কুড়া ঈগল, কাস্তেচড়া, পান ভূলানি, কালিম, টিটি, পেডিসহ ১৫ প্রজাতির পরিযায়ী পাখি এসেছে। তবে এর মধ্যে বালিহাঁসের আধিক্য বেশি। এসব পরিযায়ী পাখি ছাড়াও সাদা বক, কানি বক, পানকৌড়ি, চিল, বাজপাখিসহ দেশীয় প্রজাতির নানা পাখি রয়েছে। অধিকাংশ পাখি পানিতে নানা কায়দায় শারীরিক কসরত করছে। কিছু পাখি লেজ দুলিয়ে পোকা খুঁটে খাচ্ছে। শিকার শেষে কিছু সাদা বক খুঁটিতে বসে জিরিয়েও নিচ্ছে। ভোরের আলো যত বাড়তে থাকে, পাখিরাও তত লোকালয় থেকে দুরে বিলের ঠিক মাঝখানে নিরাপদ স্থানে সওে যেতে থাকে।
বর্ষাকাল শুরু থেকে শরৎকালের শেষভাগ এ সময় পর্যন্ত বিশাল চলনবিলে মাইলের পর মাইল মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকত নয়নাভিরাম লাল, বেগুণী ও সাদা শাপলা। বর্ষার শুরুতে শাপলার জন্ম হলেও হেমন্তের শিশির ভেজা রোদমাখা সকালে বিলে চোখ পড়লে রং-বেরঙের শাপলার বাহারী রুপ দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত। মনে হত কোন এক সাজানো ফুল বাগানের মধ্যে শ্রষ্টার শ্রেষ্ট জীব হিসেবে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছি। বিলে শাপলার নয়নাভিরাম এ দৃশ্য দেখার জন্য ছুটে আসতেন প্রকৃতিপ্রেমীরা। এখনো বিলপাড়ের অনেকেই নৌকা নিয়ে বিল থেকে শাপলা তুলে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছে।
জানা যায়, সাদা বর্ণের শাপলা সবজি হিসেবে এবং লাল রঙের শাপলা ওষুধি গুণে সমৃদ্ধ। ছোটদের কাছে শাপলা ফুল খুবই প্রিয়। বাড়তি জনসংখ্যার চাপে বিল বাওড় জমি ভরাট করে বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। জমিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল আবাদে অধিক মাত্রায় রাসায়নিক সার প্রয়োগ, জলবায়ু পরিবর্তন, অবৈধ দখল ও শুকিয়ে যাওয়ার কারণে চলনবিল থেকে বিলুপ্ত হতে চলেছে শাপলা ফুল। এখন খাল-বিল-জলাশয় থেকে হারিয়ে যাচ্ছে শাপলা। আগে অনেকে সৌন্দর্যের জন্য পুকুরে চাষ করতেন লাল শাপলা । এখন পুকুরে বিদেশি কার্প জাতীয় মাছ চাষ হওয়ায় বেগুণী ও লাল শাপলা বিলুপ্তির পথে। আগে গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারে পাওয়া যেত ঢেপের খই মোয়া। এখন আর আগের মতো পাওয়া যায় না পদ্ম মধূ ও সুস্বাদু ঢেপের খইয়ের মোয়া, শালুক ও মাছ।
পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ড. সামিউল হক জানান, প্রতি ১০০ গ্রাম শাপলা লতায় রয়েছে খনিজ পদার্থ ১.৩ গ্রাম, আঁশ ৮.৭ গ্রাম, খাদ্যপ্রাণ ১৪২ কিলোগ্রাম, ক্যালোরি-প্রোটিন ৩.১ গ্রাম, শর্করা ৩১.৭ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ০.৫২ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ০.৩২, ড্রাইমেটার ৮.৪, ক্রড আমিষ ১৬.৮, ক্রড ফ্যাট ২.৮, ক্রড ফাইবার ৬২.৩, নাইট্রোজেন ৩৫.৪, সোডিয়াম ১.১৯, পটাশিয়াম ২.২৩ ভাগ। অতীতকাল থেকেই শাপলার ফল দিয়ে চমৎকার সুস্বাদু খই ভাজা হয়। যেটি গ্রাম-গঞ্জের মানুষের কাছে ঢ্যাপের খই নামে পরিচিত। শাপলার মাটির নিচের মূল অংশকে (রাউজোম) আঞ্চলিক ভাষায় শালুক বলে। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে বিলের পানি কমে যায় তখন অভাবী মানুষ শালুক তুলে বাজারে বিক্রি করে। সেদ্ধ শালুক বেশ সুস্বাদু। শাপলা চুলকানি ও রক্ত আমাশয়ের জন্য বেশ উপকারী। ডায়াবেটি, বুকজ্বালা, লিভার, ইউরিনারী সমস্য ও নারীদের মাসিক নিয়ন্ত্রনে লাল শাপলা খুবই উপকারী ।
কৃষিবিদ মোঃ ইসমাইল হোসেন জানান, শাপলা তিন প্রকারের হয়ে থাকে। সাদা বেগুণী ও লাল রঙের। এরমধ্যে সাদা ফুল বিশিষ্ট শাপলা সবজি হিসেবে এবং লাল রঙের শাপলা ওষুধি কাজে ব্যবহৃত হয়। শাপলা খুব পুষ্টি সমৃদ্ধ সবজি । সাধারন শাক-সবজির চেয়ে শাপলার পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। শাপলায় রয়েছে প্রচুর পরিমান ক্যালসিয়াম। শাপলায় ক্যালসিয়ামের পরিমান আলুর চেয়ে সাতগুণ বেশি। খাল বিল জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ার কারণে শাপলা জন্মানো ও দেশী মাছের বংশ বিস্তারের ক্ষেত্রগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
দেশের যে কোন প্রান্ত থেকেই পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জে আসা সম্ভব। রেলপথ আরো সহজতর। চলনবিলে নৌভ্রমন করতে হলে সিংড়া উপজেলা থেকে রিক্সাযোগে সিংড়া পয়েন্ট এলাকায় আসতে হবে। এখানে ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভাড়া পাওয়া যায়। এক হাজার ৫০০ টাকা থেকে দুই হাজার টাকায় সারাদিনের জন্য নৌকা রিজার্ভ করে সমগ্র চলনবিল ঘুরে দেখা সম্ভব। নৌকায় রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। সিংড়া উপজেলার বিলদহর বাজার থেকে নৌকা ভাড়া নিয়ে সাবগাড়ী, হরদমা, জগিন্দ্রনগর নদী দিয়ে চলনবিলে প্রবেশ করা যায়। বিলশা অংশে ভ্রমনে গুরুদাসপুর থেকে আসা সহজ হবে।
এছাড়া সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, পাবনার চাটমোহর ও ভাঙ্গুড়া উপজেলা দিয়ে চলনবিলে প্রবেশ করা সম্ভব। সামগ্রীক বিবেচনায় চলনবিল বৃহৎ। এর পুরো অংশ একদিনে ঘুরে দেখা কষ্টসাধ্য। চলনবিলের সমগ্র অংশ ঘুরে দেখতে দর্শনীয় স্থানগুলো আগে চিহিৃত করে নিতে হবে। চলনবিলের অপরুপ দৃশ্যকে উপভোগ করতে বর্ষাকালকে বেছে নিতে হবে।