ড্রেজিং স্পয়েল দিয়ে বাঁধ তৈরি হচ্ছে পাবনা-সিরাজগঞ্জের সীমান্তে

0
488

শফিউল আযম ঃ
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় দেশে প্রথম বারের মতো সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার সীমান্ত এলাকায় নির্মিত হচ্ছে ব্যয় সাশ্রয়ী পরিবেশ বান্ধব বাঁধ। কোন ফসলী জমি নষ্ট না করে নদীর ড্রেজিং স্পয়েল পলি-বালু আর মাটি দিয়ে বাঁধটি নির্মাণের কারণে যমুনা নদীর নাব্যতা সঙ্কট নিরসনসহ সরকারের ব্যয় সাশ্রয় হচ্ছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। পানিসম্পদ মন্ত্রনালয়ের ফ্লাড অ্যান্ড রিভার ব্যাংক ইরোশন রিস্ক ম্যানেজম্যান্ট ইনভেস্টম্যান্ট প্রোগ্রামের (ট্রান্স-১) আওতায় এই বাঁধের নির্মাণ কাজ চলছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুরের কৈজুরি ইউনিয়নের হাটপাতিল থেকে পাবনার বেড়ার হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়নের চরপেঁচাকোলা হয়ে আহামেদপুর ইউনিয়নের রতনকান্দি পর্যন্ত যমুনা নদীর পশ্চিম ও হুড়াসাগর নদীর উত্তর পাড়ে ২১ দশমিক ০৩ কিলোমিটার ব্যয় সাশ্রয়ী পরিবেশ বান্ধব বণ্যানিয়ন্ত্রন বাঁধের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। জমি অধিগ্রহন ও বাঁধ নির্মানে প্রক্কলিত ব্যায় ধরা হয়েছে ২৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৪১ দশমিক ০৮ একর জমি অধিগ্রহনে প্রায় ১২৪ কোটি টাকা এবং বাঁধ নির্মানে ব্যয় হবে প্রায় ১২০ কোটি টাকা। প্রচলিত পদ্ধতিতে বাঁধ নির্মাণে ব্যয় হয় বিপুল পরিমান টাকা। বাঁধের মাটির জন্য বিপুল পরিমান আবাদী জমি নষ্ট হয়। প্রথম বারের মতো নদীর ড্রেজিং স্পয়েল (পলি-বালু) দিয়ে চলছে এই বাঁধের কাজ। এতে কোন আবাদী জমি অধিগ্রহনের প্রয়োজন হয়নি।
দেশে প্রথম বারের মতো সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে পাবনা ও সিরাজগঞ্জে ব্যয় সাশ্রয়ী পরিবেশ বান্ধব পলি-বালু ও মাটির দ্বারা নির্মানাধীন বাঁধটি প্রধানমন্ত্রী বিশেষ প্রকল্প হওয়ায় দাতা সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, পানি সম্পদ মন্ত্রনালয় এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ নিয়মিত প্রকল্প কাজ পরিদর্শন করে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। সেই নির্দেশনা অনুয়ায়ী বাঁধের নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বাঁধের নির্মাণ কাজ সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কৈটোলা নির্মাণ বিভাগের তত্বাবধানে পাঁচটি গ্রুপে বিভক্ত এই বাঁধের নির্মাণ কাজ করছে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। স্কেভেটর মেশিন দিয়ে গর্ত করে দুই পাশে রিং বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। ড্রেজারের সাহায্যে যমুনা নদী খনন করে ড্রেজিং স্পয়েল (পলি-বালু) পাইপের সাহায্যে রিং বাঁধের ভেতরে ফেলা হচ্ছে। দুই ফুট উচু করে পলি বালু ফেলে পানি ঝরে যাওয়ার পর চেইনডোজারের সাহায্যে ৯০ ভাগ ম্যাকানিক্যাল কমপ্যাকশন করা হচ্ছে। এই ভাবে স্তর বাই স্তর ম্যাকানিক্যাল কমপ্যাকশন এবং পলি বালু ৯০ ভাগ ময়েশচার ফ্রি করা হয়েছে। বাঁধের টপ ৩০ ফুট চওড়া। দুই পাশে ১ ঃ ৩ আনুপাতিক হারে স্লোপ তৈরি করা হচ্ছে। বাঁধের স্লোপ ও টপের পলি-বালুর উপর দুই ফুট পুরু করে এঁটেল মাটি ফেলে কমপ্যাকশন করা হচ্ছে, হয়েছে।
বাঁধের স্লোপ সংরক্ষনের জন্য ব্যয় বহুল সিসি ব্লকের পরিবর্তে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ রিভার সাইডের চরপেঁচাকো থেকে পশ্চিমে এক হাজার ৯০০ মিটার এলাকায় ব্যয় সাশ্রয়ী পরিবেশ বান্ধব জুট ম্যাটেস ব্যবহার করা হবে। এছাড়া প্রায় ২০ কিলোমিটার বাঁধের উভয় পাশে টেকসই বিন্না ঘাস লাগানো হচ্ছে। বিন্না ঘাস মাটির ঘনত্ব বাড়াতে সাহায্য করে। এতে বৃষ্টির ধারা ও ¯্রােতের টান থেকে মাটির ক্ষয় রোধ হবে। আগামী জুন মাসে বাঁধের কাজ শেষ হবে। ইতোমধ্যে ৭০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
প্রতিবছর বর্ষা মওসুমে যমুনা ও হুড়াসাগর নদীর পানি বাড়লে পাবনার বেড়া উপজেলার একটি ইউনিয়নসহ সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ বণ্যা কবলিত হয়। বণ্যার পানিতে ফসল হারিয়ে নিঃস্ব হয় এলাকার কৃষক। আগামী বর্ষা মওসুমের আগেই বাঁধ ও চারটি স্লুইসগেট নির্মাণ কাজ শেষ হবে। বাঁধ তৈরি হলে সাড়ে ছয় হাজার হেক্টর পরিমান এলাকা বণ্যামুক্ত হবে। স্লুইসগেটের মাধ্যমে প্রায় পাঁচ হাজার হেক্টর জমি নিস্কাশন সুবিধা পাবে। এক ফসলী জমি তিন ফসলীতে রুপান্তরিত হবে। বাঁধের অভ্যন্তরে সারা বছর শাক-সবজিসহ অন্যান্য কৃষিজপণ্য উৎপন্ন হবে। লক্ষাধিক মানুষ বন্যার ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে। উন্নত যোগাযো ব্যবস্থা স্থাপিত হওয়ায় কৃষকেরা সহজেই উৎপাদিত কৃষিজপণ্য সিরাজগঞ্জ জেলা শহরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বাজারজাত করতে পারবেন। এতে বণ্যাপ্রবণ প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে।
বাঁধের পাশে চিতুলিয়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আব্দুস ছালাম জানান, তার বাড়ী দুই বার যমুনা নদীতে বিলীন হয়েছে। সে পাঁচ বছর আগে ওমরপুর চরে বাড়ী করেছে। চরের অন্যান্য বাড়ীর মতো তার বাড়ীর ঢালেও (স্লোপ) বিন্না ঘাস লাগিয়েছেন। বিন্না ঘাসের অসংখ্য শিকর মাটির গভীরে গ্রথিত হয়ে মাটি শক্তভাবে ধরে রাখে। এতে বৃষ্টির ধারা, স্্েরাতের টান ও ঢেউয়ের আঘাত থেকে মাটির ক্ষয় রোধে হয়। বিন্না ঘাস গো-খাদ্য ও ঘরের ছাওনি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
আহমেদপুর ইউনিয়নের রতনকান্দি গ্রামের কৃষক ফজর আলী বলেন, এখন জমিতে তিনটি ফসল ফলেবে। সারা বছর শাক-সবজির আবাদ করা যাবে। আমাদের উৎপাদিত ফসল নিয়ে আর কোন সমস্যায় পড়তে হবে না। বাঁধটির নির্মাণ কাজ পুরোপুরি শেষ হলে উন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপিত হবে। সহজেই উৎপাদিত কৃষিজপণ্য বাজারজাত কর্ াযাবে। ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়া নিশ্চিত হবে। প্রত্যন্ত এ অঞ্চলের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটবে। গো-খাদ্যের অভাব দুর হবে।
বেড়ার হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ড মেম্বর চরপেঁচাকোলা গ্রামের বাসিন্দা মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, আমাদের দীর্ঘ দিনের দাবি ছিল বাঁধ নির্মাণ। মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের দাবি পূরণ করেছেন। বাঁধ হওয়ার কারণে ৮টি ইউনিয়নের জনসাধারন সুবিধা ভোগ করবে। আগে এ অঞ্চলের জমিতে এক ফসল আবাদ হতো। এখন তিন ফসল আবাদ করা যাবে। এক বছর আগে এক বিঘা জমি বিক্রি হতো ৫০-৬০ হাজার টাকায়। এখন প্রতি বিঘা জমি বিক্রি হচ্ছে দুই থেকে তিন লাখ টাকা। দিন দিন জমির দাম বেড়েই চলেছে। তিনি জানান, বেড়ার হুড়াসাগর নদীর উপর ব্রীজ নির্মাণ কারা হলে এই বাঁধ দিয়ে পাবনা থেকে যমুনা সেতু হয়ে ঢাকা পৌঁছানো যাবে। সড়ক পথে পাবনার সাথে ঢাকার দুরত্ব কমবে প্রায় ৭০ কিলোমিটার। এতে সময়, জ্বালানী তেল ও অর্থের সাশ্রয় হবে। যাত্রী সাধারনের ভোগান্তি কমবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়া কৈটোলা নির্মাণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবীব বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনয়ায়ী ফসলী জমির ক্ষতি না করে নদী ড্রেজিংয়ের পলি-বালু দিয়ে বণ্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। এরফলে একদিকে যমুনা নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি পাবে আপরদিকে প্রকল্প এলাকায় বণ্যা প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করার মাধ্যমে বণ্যার ঝুঁকি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে।
বণ্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ এবং নিস্কাশন অবকাঠামো নির্মাণের ফলে এক ফসলী জমিতে এখন তিন ফসল ফলবে। প্রকল্প অভ্যন্তরে অধিক ফসল উৎপাদন নিশ্চিত হবে। বণ্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ হলে এলাকায় উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। চাষিরা তাদের উৎপাদিত কৃষিজপণ্যের ন্যায্য দাম পাবেন। বাঁধের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে স্লোপ প্রটেকশনের জন্য দেশে প্রথম বারের মতো কম খরচে পরিবেশ বান্ধব জুট ম্যাটেস ব্যবহার করা হবে। এছাড়া স্লোপ সংরক্ষনের জন্য বিন্না ঘাস লাগানো হচ্ছে। এই প্রকল্পটি সফলভাবে বাস্তবায়ন হলে দেশের অন্য প্রকল্পে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে বলে তিনি জানান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here