পদ্মায় নেই কোন বালু মহল; তবুও চলছে বালু উত্তোলণ

0
335

শফিউল আযম ঃ
পদ্মা নদীতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন যেন কিছুতেই থামছে না। পদ্মায় কোন বালু মহলও নেই। তবু সরকারি দলের কিছু প্রভাবশালী নেতা সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সুজানগর উপজেলায় অভৈধভাবে বালু উত্তোলন অব্যাহত রেখেছে। সুজানগর উপজেলার পদ্মা প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকায় শতাধিক ড্রেজার দিয়ে অবাধে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এসব এলাকায় গেলে বালু উত্তোলনের মহোৎসব দেখে চোখ কপালে উঠার উপক্রম। সমস্ত নদী জুড়ে চায়না ড্রেজার আর ড্রেজার। শুধুমাত্র নাজিরগঞ্জেই ২২টি চায়না ড্রেজার কাটার দিয়ে বালু কাটা হচ্ছে। যত্রতত্র বালু তোলায় এ অঞ্চলে পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা মানুষের জীবনে মারাত্মক বিরুপ প্রভাব ফেলছে।
ইতোমধ্যে নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের হাসামপুর, বুলচন্দ্রপুর, বরকাপুরে ভাঙ্গনের কবলে শতশত একর জমি বিলীণ হয়েছে। বুলচন্দ্রপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় যে কোন সময় নদীতে বিলীণ হবার পথে। রাইপুর মসজিদ, কামারহাট মন্দির ভাঙ্গনের ঝুঁকিতে রয়েছে। পাবনা সদর থানার ভাড়ারায় শতশত বিঘা জমি নদীতে বিলীণ হয়েছে। এসব ইউনিয়নে হাজার হাজার একর ফসলি জমি ও বসতবাড়ি ভাঙ্গন আতঙ্কে মানুষের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বাড়ছে। সুজানগর পৌরসভার চর মানিকদির এলাকার এক কৃষক কান্নাজড়িত কন্ঠে জানান, তার ১০ বিঘা আবাদিজমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হেলাল উদ্দিন নামে আরেক কৃষক জানান প্রকাশ্যে এভাবে পদ্মা নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হলেও তা বন্ধে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন কোন কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক মন্টু প্রামানিক জানান, বালু উত্তোলনকারীরা তাদের জমির উপর দিয়ে রাস্তা তৈরি করে প্রতিদিন ভারী যানবাহণ দিয়ে বালি পরিবহণ করায় শত শত বিঘা ফসলী জমি ইতোমধ্যে নদীতে বিলীণ হয়েছে। প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত ড্রাম ট্রাক, ট্যাক্টর, দিয়ে বিভিন্ন স্থানে পেঁৗঁছে দেয়া হচ্ছে। আবার অন্যদিকে ভারী যানবাহনের মাধ্যমে বালু পরিবহণ করায় এসব রাস্তার অবস্থাও নাজুক হয়ে পড়েছে। সরকার কোট কোটি টাকা ব্যয়ে সড়ক নির্মাণ করলেও বালির ভারী ট্রাকের চাপে কোন রাস্তাই ২-৩ মাসও স্থায়ী না হওয়ায় সাধারণ মানুষের নানা বিড়ম্বনায় যাতায়াত করতে হচ্ছে। সুজানগর উপজেলার পদ্মা নদীর ভাঙ্গন রক্ষায় ১২ কোটি টাকার নদী শাসন প্রকল্পের কাজ চলমান থাকলেও গোটা টাকাই গচ্চা যাওয়ার আশঙ্কায় সংশ্লিষ্টরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, কোটি কোটি টাকার এ বালু ব্যবসাকে কেন্দ্র করে প্রভাবশালীদের নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ওই সিন্ডিকেটে প্রশাসনিক কর্মকর্তার নাম উঠে আসায় কেউ প্রতিবাদ ও করতে পারছেনা। ইতোপুর্বে নাজিরগঞ্জে যুবলীগের নেতাকর্মীরা বালি উত্তোলনের প্রতিবাদ করতে সমবেত হলে তাদের পুলিশ দিয়ে বেধরক মারপিটসহ তাদের অন্তত ৮টি মোটর সাইকেল পুলিশ আটক করে বলে অভিযোগ রয়েছে। বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসনের ব্যর্থতায় উচ্চ আদালত গত জানুয়ারিতে কঠোর মনোভাব প্রকাশ করলে প্রশাসন মাঠে নামে। গত ২৭ জানুয়ারি সুজানগরের ৯টি পয়েন্টে অবৈধভাবে উত্তোলিত ১২টি জব্দকৃত বালুস্তূপ ২২ লাখ ৩০ হাজার ৮০০ টাকায় প্রকাশ্য নিলামে বিক্রি করে। কয়েক কোটি টাকার বালি এ নামমাত্র মুল্যে উত্তোলনকারিরাই ক্রয় কওে নেয়। এরপর কিছুদিন বালি তোলা বন্ধ রাখার পর আবার অবাধে তোলা হচ্ছে। একটি সুত্র জানায়, যেসব পয়েন্টে বালু নিলাম হয়েছে সেখানেই নুতনভাবে বালু তুলে স্তুপ করা হচ্ছে। প্রশাসন কখনও যদি মাঠে নামলে তারা এ বালু নিলামে কেনা বলে দাবি করে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারিভাবে বালু মহল ইজারা না থাকলেও আইনের তোয়াক্কা না করেই অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। সুজানগরের এক প্রভাবশালী নেতার বিরুদ্ধে অবৈধ বালু উত্তোলন সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ উঠেছে। এ বালু সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে তিনি প্রতিদিন ২০-২৫ লাখ টাকা আয় করছেন বলেও অভিযোগে জানা গেছে। তার পরিবার পরিজনের নামে বেনামে ঢাকা, পাবনা ও সুজানগরে কয়েকটি বিলাসবহুল বাড়ি, বেশ কয়েকটি দামি গাড়ি ও শতশত বিঘা জমির মালিক হওয়ার ও অভিযোগ উঠেছে। নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের নাছির খলিফা, তার ছেলে সজিব খলিফা, রফিক বালু উত্তোলন করছে। নাসির খলিফার মোবাইলে বারবার চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সদর উপজেলার ভাড়ারা ইউনিয়নের আবু সাঈদ ও চরতারাপুর ইউনিয়নে সিদ্দিকের বিরুদ্ধে বালি উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে। যদিও তারা এর সাথে জড়িত নয় বলে দাবি করেন।
অবাধে বালু উত্তোলনে মাঠ-ঘাট ফসলি জমি নদীতে বিলীণ হওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকারের ভাবমুর্তি প্রশ্নের সন্মুখিন হয়ে পড়েছে। ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় নেতার বালু উত্তোলনে খোদ সরকারি দলের ত্যাগি নেতাকর্মীরা ক্ষোভের আগুনে যেন ফুঁসছেন। এনিয়ে মানববান্ধণ করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের উপর হামলা পর্যন্ত করা হয়েছে। নামপ্রকাশে একাধিক নেতা কর্মী জানান, বালু উত্তোলণসহ অবৈধ পথে কতিপয় দলীয় নেতার সম্পদের পাহাড় গড়ার ঘটনা এখন সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে। কতিপয় নেতার কারণে দলের ভাবমুর্তি এখন প্রশ্নের মুখোমুখি বলেও তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিক্ষুব্ধ ত্যাগি নেতাকর্মীরা দলীয় ক্ষমতার অপব্যবহারকারী এসব নেতার সম্পদের অনুসন্ধাণসহ প্রয়োজনিয় ব্যবস্থা গ্রহণেরও দাবি তুলেছেন।
সুজানগর উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ওই নেতা বালু তোলার অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছেন, তিনি বালু উত্তোলনের সাথে জড়িত না। নাজিরগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও যুবলীগ নেতার বালু উত্তোলণ সম্পর্কে তিনি প্রকারান্তে জানেন বলে স্বীকার করেন। তাদের বিরুদ্ধে কোন দলীয় ব্যবস্থা নেয়ার ব্যপারে জানতে চাইলে তিনি তাদের অপারগতার কথা জানান।
বালু উত্তোনে সবচেয়ে বড় অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়েছে পদ্ম পাড়ের মানুষ। অবাধে বালু তোলায় পদ্মার ভাঙ্গনে কৃষিজমি ও বাড়িঘর হারিয়ে হাজার হাজার কৃষক ভূমিহীনে পরিণত হয়েছে। কৃষকরা যেমন ফসলী জমি হারিয়ে সর্বশান্ত হচ্ছে, তেমনি সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। অন্যদিকে চলতি মৌসুমে সরকারের নদী শাসনের ১২ কোটি টাকার প্রকল্প কোন সুফলে আসছে না। প্রশাসনের কর্মকর্তারা এ ব্যাপারে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় নদীপাড়ের ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ
পাবনা-২ আসনের সংসদ সদস্য আহম্মদ ফিরোজ কবির বালু উত্তোলণের বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, আমি ডিসি, এসপি, ইউএনও ,এএসপি সার্কেলকে বহুবার বলেও কাজ হয়নি। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, যারা বালু উত্তেলণ বন্ধ করবে তারাই যদি ম্যানেজ হয় তাহলে কিভাবে বালি উত্তেলান বন্ধ হবে বলে তিনি প্রশ্ন রাখেন। তার কথাতেও বালু তোলা বন্ধ না হওয়ায় তিনি অসহায়বোধ করছেন বলে জানিয়েছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here