পাবনার হাট-বাজারে দেশি মাছের আকাল চলছে নিন্ম আয়ের মানুষ চাষের মাছ খেতে বাধ্য হচ্ছে

0
491

শফিউল আযম বেড়া সংবাদদাতা:পাবনার গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজার এক সময় দেশি মাছে সয়লার হয়ে যেত। এখন সেসব মাছ তেমন দেখা যায় না। নদী-বিল-জলাশয়ে জেলেদের জালে পর্যাপ্ত মাছ ধরা পড়ে না। দেশীয় মাছের মধ্যে রয়েছে- কৈ, মাগুর, শিং, পাবদা, টেংরা, পুঁটি, মলা, চেলা, শৌল, বোয়াল, আইড়, ভ্যাদা, বাইম, খলিসা, ফলি, চিংড়ি, গজার, চিতল, কাকিলা, বৌরানীসহ প্রায় ৫০ প্রজাতির মাছ। এসব মাছ হারিয়ে যাওয়ার পেছনে অন্তত ১৪টি কারণকে চিহিৃত করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

অগ্রহায়ণ-পৌষ-মাঘ মাসে পুকুর, খাল, ডোবা, ঘেরের পানি কমতে থাকলে দেশি মাছ ধরার ধুম পড়ে যেত। এখন সেসব দেখা যায় না। বর্ষাকালে ধানের জমিতে কইয়া জাল, বড়শি ও চাই পেতে মাছ ধরার রীতিও হারিয়ে গেছে অনেক এলাকা থেকে। যারা এক সময় যারা পুকুর, খাল-বিল, ডোবা, নালায় মাছ ধরে পরিবারের চাহিদা পূরণ করতেন, এখন তাদেরকে বাজার থেকে মাছ কিনতে হচ্ছে। দেশি মাছের আমদানি কম ও দাম বেশি হওয়ায় চাষের মাছ কিনে খেতে বাধ্য হচ্ছেন বলে অনেকেই জানিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশীয় মাছ হারিয়ে যাওয়ার জন্য মূলত অনেকগুলো কারণ দায়ী। এরমধ্যে জলবায়ুর প্রভাব, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, অবৈধ কারেন্ট জালের অবাধ ব্যবহার, জলাশয় দূষণ, নদ-নদীর নাব্যতা হৃস, উজানে বাঁধ নির্মাণ, নদী সংশ্লিষ্ট খাল-বিলের গভীরতা কমে যাওয়া, ডোবা ও জলাশয় ভরাট করা, মা মাছের আবাসস্থলের অভাব, ডিম ছাড়ার আগেই মা মাছ ধরে ফেলা, ডোবা-নালা-পুকুর ছেঁকে মাছ ধরা, মাছের প্রজননে ক্ষেত্র সংকুচিত হওয়া। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এই ১৪টি কারণে ৫০টির বেশি দেশি প্রজাতির মাছ হারিয়ে যেতে বসেছে।

পাবনা মৎস্য বিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছেন, হারিয়ে যাওয়া দেশি প্রজাতির মাছের সংখ্যা পঞ্চাশের বেশি। হাটবাজারে এখন আর মিঠাপানির সুস্বাদু দেশি মাছ মিলছে না। দেশে হাইব্রিড জাতের সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, মিরর কার্প, কমন কার্প, বিগহেড, থাইসরপুঁটি, থাই কৈ, থাই পাঙ্গাস, ব্লাক কার্প, আফ্রিকান মাগুর, পাঁচ প্রজাতির তেলাপিয়াসহ ২৪ প্রজাতির মাছ চাষ হচ্ছে। হাইব্রিড জাতের মাছ চাষের আগে পুকুর ডোবার পানিতে নানা প্রকার বিষ মেশানোর কারনে মাছ, শামুক ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর প্রজনন ক্ষমতা হ্রস পাচ্ছে। মৎস্যজীবিরা জানিয়েছেন, অধিক মুনাফার আশায় হাইব্রিড মাছের চাষ করতে গিয়ে জলাশয়গুলো থেকে দেশি মাছের বিলুপ্ত ঘটানো হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কৃষি ও চাষাবাদ ব্যবস্থার পরিবর্তনের কারণে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। একই সঙ্গে পোনা আহরণ নেটজাল ও মশারি জাল ব্যবহার করে খালে-বিলে-নদীতে মাছ ধরার কারণেও দেশীয় প্রজাতীর মাছ বিলুপ্ত হচ্ছে। মৎস্য বিভাগের সূত্র জানিয়েছে, দুই দশক আগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় আড়াই’শ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ পাওয়া যেত।

বেড়া চতুরবাজারের মাছ ব্যবসায়ী সাঁথিয়া উপজেলার পানশাইল গ্রামের আদম আলী বলেন, ‘২০-২৫’ বছর আগে আমাদের এলাকায় মাছ কিনে খাওয়ার তেমন রেওয়াজ ছিল না। কেনার মধ্যে শুধু ইলিশ মাছ কেনার কথাই মনে পড়ে। মাছের প্রয়োজন হলে সবাই বাড়ীর সামনে খালে বা নদীতে চলে যেত। খালে পুকুরে তখন এতো মাছ ছিল যে, পানিতে নেমে খালি হাতে মাছ ধরতে পারতো।
এ প্রসঙ্গে আফড়া বিল পাড়ের আফড়া গ্রামের মৎস্য খামারি কাদের আলী বলেন, তাদের বাড়ীর পাশে বিল ছিল। জন্মের পর থেকেই বিল দেখছি। ২০-২২ বছর আগে সারা বছর ধরে বাড়ির সবাই বিল থেকে মাছ ধরতো। শীত মওসুমে শত শত মানুষ পলো, জাল, ডালা, খুচন নিয়ে মাছ ধরতে নেমে যেত। কেউ কেউ খালি হাতে মাছ ধরত। বোয়াল, কাতল, মৃগেল, লওলা, শোল, গজার, কৈ, মাগুর, শিং, পাবদা, টেংরা, পুঁটি, আইড়, ভ্যাদা, বাইম, খলিসা, ফলি, চিংড়ি, চিতলসহ বিভিন্ন জাতের মাছ ধরা পড়ত। এখন ওই বিল শুকিয়ে যায়। চেলা, পুটি, টাকি, খলিসা ছাড়া কোন মাছ নেই।

আফড়া গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নাজিম মিয়া, আবুল হোসেন, জামাল ব্যাপারী, হোসেন প্রামানিক জানিয়েছেন, স্থানীয় পুন্ডুরিয়া বাজারে প্রতিদিন দেশি প্রজাতির অনেক মাছ উঠত। এখন আর সেসব মাছ ওঠে না। বাজার ভরা থাকে চাষের সিলভার কার্প, গ্রাস কার্প, মিরর কার্প, কমন কার্প, বিগহেড, থাইসরপুঁটি, থাই কৈ, থাই পাঙ্গাস, ব্লাক কার্প, আফ্রিকান মাগুর, তেলাপিয়ায়। দেশি মাছ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বিল শুকিয়ে যাওয়া, ইরি ধান ও অন্যান্য সবজিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারকে দায়ী করেন।

পাবনার সুজানগর উপজেলার তালিমনগর গ্রামের কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি জানালেন, প্রায় ২০-২৫ বছর আগে পদ্মা নদী সংযুক্ত এলাকার আত্রাই ও বাদাই নদীতে দেড় থেকে দুই কেজি ওজনের ইলিশ মাছ পাওয়া যেত। পাওয়া যেত ১২ থেকে ১৪ কেজি ওজনের বোয়াল, পাঙ্গাস, বাঘাইড়, কাতল ও আইড় মাছ। এমন কোন মাছ ছিল না যা এ অঞ্চলের নদী-বিলে পাওয়া যেত না। এলাকার গাজনার বিলে তারা জাল দিয়ে ৮ কেজি ওজনের কালবাউশ মাছ ধরেছেন। এক সময় ছিল বেলে, চেলা, ভেদা, চেং, গুচিয়া বাইম, খসল্লা মাছ খাওয়ার অযোগ্য মনে করে ধরার পর ফেলে দিতেন। এখন আর সেদিন নেই বলে তারা জানিয়েছেন।

মৎস্য বিশেজ্ঞরা বলছেন, নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, জলাশয় ও প্লাবন ভূমি ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি ধারনক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। সরকারি উদ্যোগে নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, জলাশয় ও প্লাাবন ভূমি পূনঃখননের মাধ্যমে পানি ধারনক্ষমতা বাড়ানো হলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। অন্যথায় দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্তির তালিকায় ঠাঁই নেবে। বেড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা শাম্মী শিরীন বলেন, বিভিন্ন কারণেই দেশি প্রজাতির মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। পাবদা, গোংসা, বোয়াল, আইড়, শিং মাছের চাষ হচ্ছে। পাঙ্গাসের চাষ হচ্ছে বেশ ক’বছর আগে থেকেই। কৈ মাছেরও চাষ হচ্ছে। দেশি প্রজাতির মাছ রক্ষায় মৎস্য অধিদফতর প্রতি বর্ছ মৎস্য মেলার আয়োজন করে আসছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here