পাবনায় আগাম ঝড়, বৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টিতে কাঁচা রসুনে পচন

0
439

শফিউল আযম ঃ
চলতি মওসুমে পাবনা জেলায় আগাম বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি ও ঝড়ে রসুনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। হাটবাজারে প্রতিমণ নতুন রসুন এক হাজার ২০০ টাকা থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গত বছর এ সময়ে প্রতিমণ রসুন বিক্রি হয়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা দরে। এতে সে সময় রসুনচাষিরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হন। এদিকে কাঁচা রসুনে পচন ধরায় সংরক্ষণ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। ফলে ব্যাপক লোকসানের আশঙ্কায় পাবনার রসুনচাষিদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারন বিভাগ সুত্রে জানা যায়, দেশের উত্তরের চলনবিল অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি রসুন আবাদ হয়। রসুন এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান ফসলে পরিণত হয়েছে। চলতি মওসুমে পাবনা জেলায় ১১ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে রসুন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮৯ হাজার ২৫০ টন। চলনবিল অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর উপজেলা। জেলার চাটমোহরে সবচেয়ে বেশি রসুন আবাদ হয়। এবার চাটমোহরে সাত হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে রসুন আবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৬ হাজার ২৫০ টন। পাবনা সদর, সুজানগর, বেড়া, সাঁথিয়া, আটঘড়িয়া, ঈশ্বরদী, ফরিদপুর ও ভাঙ্গুড়া উপজেলায় চার হাজার ৪০০ হেক্টরে ৩৩ হাজার টন রসুন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এসব এলাকায় প্রতি বছরই রসুন আবাদের পরিমান বাড়ছে। চলনবিল অঞ্চলে বিনা চাষে রসুন আবাদ হয়। এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি রসুন আবাদ হয় নাটোরের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর এবং পাবনার চাটমোহর উপজেলায়।
পাবনার চাটমোহর উপজেলার ছাইকোলা, কাটেঙ্গা, কোকড়াগাড়ি, ধানকুনিয়া, লাঙ্গলমোড়া, বরদানগর, ধুলাউড়ি, বোয়ালমারি, গৌরনগর, বিন্যাবাড়ি, নিমাইচড়া, সুজানগর উপজেলার গাজনার বিল, সাঁথিয়া উপজেলার ঘুঘুদাহ বিল, গাঙভাঙ্গা বিল এলাকায় সবচেয়ে বেশি রসুন আবাদ হয়েছে। চলনবিল অঞ্চলে বণ্যার পানি নেমে যাওয়ার পরই পলিযুক্ত বেলে দোঁ-আশ ও এঁটেল দোঁ-আশ মাটিতে রসুন রোপন করা হয়। ঘন ঘন বৃষ্টি, কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, শিলাবৃষ্টি ও ঝড়ে রসুনের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় ফলন বিপর্যয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া বৃষ্টির কারণে শুকাতে না পারায় কাঁচা রসুনে পচন ধরেছে। এতে এ অঞ্চলের রসুনচাষিরা ব্যাপক লোকসানের আশঙ্কা করছেন।
গত শনিবার চাটমোহর উপজেলার ছাইকোলা, কাটেঙ্গা, কোকড়াগাড়ি, ধানকুনিয়া, লাঙ্গলমোড়া, বরদানগর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, চলনবিল এখন বিস্তীর্ণ মরুভুমির মতো। চলনবিল অঞ্চলের ৩৯টি বিল, ১৬টি নদী ও ২২টি খাড়ীর বেশির ভাগেই এখন পানি নেই। মাঠের পর মাঠ হয়েছে রসুনের আবাদ। শুকিয়ে বিবর্ণ রসুনের গাছ। শ্রমিকরা মাঠ থেকে রসুন তুলে জমিতেই পালা করছে। কেউবা কান্ড থেকে রসুন কেটে আলাদা করছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, রসুনের কোয়াগুলো অপুষ্ট ও রোগাক্রান্ত। মাঠ থেকে কয়েকজন কৃষক জানান, মাঠে রসুন পুষ্ট হওয়ার আগেই বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। এতে কান্ড পচে মরে গেছে। কাঁচা রসুনে পচন ধরায় ভাল দামও মিলছে না। বাজারে প্রতিমণ ভাল রসুন এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজা ৪০০ টাকা এবং খারাপ মানের রসুন ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে।
চাটমোহর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের ধুলাউড়ি গ্রামের চাষি আব্দুল আলীম জনান, প্রতি বিঘা জমিতে ৩০ কেজি টিএসপি সার, ২৫ কেজি পটাশ সার ও ১৫ কেজি জিপসাম সার ছিটানোর দুই-একদিনের মধ্যে নরম জমিতে সারিবদ্ধভাবে রসুন বীজ রোপণ করতে হয়। রোপণের জন্য প্রতি বিঘা জমিতে দুই মণ রসুনের প্রয়োজন হয়। জমিতে রসুন রোপণের দিনই খড় বা বিচালী দিয়ে জমি ঢেকে দিতে হয়। বীজ রোপণের একমাস পরে পানি সেচ দিয়ে বিঘায় ১০ কেজি হারে ইউরিয়া সার ও পাঁচ কেজি হারে এমওপি সার ছিটিয়ে দিলে ফলন ভালো হয়। প্রতি বিঘা জমিতে রসুন আবাদে খরচ হয় ২০ হাজার থেকে ২২ হাজার টাকা। জমি লীজ নেয়া হলে আরো খরচ হয় আট হাজার টাকা। এতে মোট খরচ দাঁড়ায় প্রায় ৩০ হাজার টাকা।
চলতি মওসুমে এক বিঘা জমিতে রসুন পাওয়া যাচ্ছে সর্বোচ্চ ২০ থেকে ২২ মণ। যার বর্তমান গড় বাজারমূল্য ২২ হাজার থেকে ২৪ হাজার টাকা। আর মান খারাপ হলে বিক্রিয় মূল্য কমে দাঁড়ায় ১৫ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকা। মূলগ্রাম ইউনিয়নের মূলগ্রামের কৃষক জাহেদ আলী জানান, তিনি দুই বিঘা জমিতে রসুর আবাদ করেছিলেন। সার, বীজ ও শ্রমিকসহ তার খরচ হয়েছে ৪৪ হাজা টাকা। রসুন পেয়েছের ৩৮ মণ। বিক্রি করলে বড়জোর ৩৭ হাজার টাকা পাবেন। ফলে নিজের শ্রমসহ তিনি ছয় হাজার টাকা লোকসান দিতে চলেছেন।
জানা যায়, ১৯৯৫-৯৬ সালের দিকে চলনবিল অঞ্চলের কৃষকেরা স্ব-উদ্যোগে প্রথম বিনা চাষে রসুন আবাদের প্রচলন শুরু করেন। এই রসুনের আবাদ বা চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে মূলগ্রামের গ্রামের কৃষক মোঃ আজাহার আলী সরদার জানান, চলনবিল অঞ্চলের জমিতে সাধারণত বণ্যার পানি নেমে যাওয়ার পর কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে নরম জমিতে বিনা চাষে রসুনের কোয়া রোপণ করা হয়। এ জন্য প্রচলিত নিয়মে জমি চাষ করার প্রয়োজন পড়ে না। এ পদ্ধতিতে ক্ষেতে আগাছা কম জন্মে। সার প্রযোগ করতে হয় কম। রোপণ থেকে উৎপাদণ পর্যন্ত ১২০ দিনের এই রসুন উৎপাদন খরচ তুলনামূলকভাবে পুরনো পদ্ধতির আবাদের চেয়ে অনেক কম। বিনা চাষ পদ্ধতিতে রসুনের ফলন বেশি হয়। প্রতি বিঘা জমিতে রসুনের ফলন পাওয়া যায় ২৫ থেকে ৩০ মণ। সাধারণত চৈত্র মাসে জমি থেকে রসুন তুলে আনা হয়। তবে এবার ঘন ঘন বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি ও ঝড়ে রসুনের ফলন কম হয়েছে এবং রসুনে পচন ধরেছে।
সুজানগর উপজেলার বিলগাজনা গ্রামের কৃষক আদম আলী ব্যাপারী বলেন, ‘গেলবার লুকসান দিয়ে ভাবছিলেম ইবার লাব হবি। ইবারও হেই লুকসানই। একে তো ঝড়বৃষ্টি, আবার দামও। রসুন তুলতিঊ পারতেছিনে, বেচতিঊ পারতেছিনে।
চাটমোহরের অমৃতকুন্ডা হাট, মির্জাপুর হাট, ছাইকোলা হাট, সাঁথিয়ার বনগ্রাম, কাশিনাথপুর, আতাইকুলা, বোয়াইলমারি, বেড়ার সিঅ্যান্ডবি চতুরহাট, নাকালিয়াহাট রসুন বিক্রির জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছে। রসুন বেচাকেনার জন্য বিভিন্ন হাট-বাজারে গড়ে উঠেছে অসংখ্য আড়ৎ। চট্রগ্রাম, সিলেট, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রসুনের বেপারী এসে আরৎদারদের মাধ্যমে চাহিদা অনুয়ায়ী রসুন কিনছেন। পরে রসুন বস্তায় ভরে ট্রাকে করে সড়ক পথে নিজ নিজ গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে হাট-বাজারে মান ভেদে গত বছরের প্রতি মণ শুকনা রসুন ৭০০ টাকা থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
বেড়ার সিঅ্যান্ডবি চতুরহাটে রসুন বিক্রি করতে আসা খোরশেদ আলম, এবাদ আলী, রজব প্রামানিক বলেন, প্রতি বছরই কৃষকদের রসুন যখন বেচা হয়ে যায়, তখন রসুনের দাম বাড়ে। এতে তাদের কোন লাভ হয় না। সারা বছর খেটে আবাদ করে রসুনের উৎপাদন খরচ ওঠেনা। এ বছর জমি থেকে রসুন তোলা এবং শুকানো পর বিক্রি করে লোকসান গুনতে হচ্ছে।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আজাহার আলী জানান, বেলে দোঁ-আশ মাটি রসুন চাষের জন্য বেশি উপযোগী। এ কারণেই জেলার চাটমোহর উপজেলায় সর্বাধিক জমিতে রসুন চাষ হয়। জমিতে টিএসপি, পটাশ ও জিপসাম ছিটানোর দুই-একদিনের মধ্যে নরম জমিতে সারিবদ্ধভাবে রসুন বীজ রোপণ করতে হয়। রোপণের জন্য প্রতি বিঘা জমিতে দুই মণ রসুনের প্রয়োজন হয়। জমিতে রসুন রোপণের দিনই খড় বা বিচালী দিয়ে জমি ঢেকে দিতে হয়। বীজ রোপণের একমাস পরে পানি সেচ দিয়ে জমিতে ইউরিয়া ও এমওপি সার ছিটিয়ে দিলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, এবার আগাম ঝড়, বৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টিতে রসুনের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। আমরা দ্রুত মাঠ থেকে রসুন তুলে আনতে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি। এবর মওসুমের শুরুতে দাম একটু কম থাকলেও পরবর্তী সময়ে দাম বাড়বে বলে আমাদের আশা রয়েছে। ফলে কৃষকরা ঠিকমতো রসুন ঘরে তুলতে পারলে লোকসান অনেকটাই কমে যাবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here