শফিউল আযম বেড়া সংবাদদাতা:দেশের উত্তরাঞ্চলের মাঠে মাঠে চোখ জুড়ানো হলুদ ফুলের সমারোহ। মাঠগুলো যেন হলুদ চাদরে মোড়ানো। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলে গেছে প্রকৃতির রুপ। প্রান্ত জুড়ে উঁকি দিচ্ছে সরিষা ফুলের দোল খাওয়া গাছ। সরিষার সবুজ গাছের হলুদ ফুল শিশির ভেজা শীতের সোনাঝরা রোদে ঝিকমিকিয়ে উঠছে। যেন প্রকৃতি সেজেছে হলুদবরণ সাজে। হলুদ রঙের আভার সাথে বাতাসে বইছে মৌ মৌ গন্ধ। মৌমাছি ও মৌচাষিরা ব্যস্ত মধু আহরণে। চোখ জুড়ানো এমন দৃশ্য দেখতে প্রকৃতিপ্রেমীরা ভিড় করছেন মাঠে, সপরিবারে তুলছেন ছবি।
পাবনা-নাটোর-সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের কৃষকরা বোরো আমনের লোকসান পুষিয়ে নিতে ব্যাপকভাবে সরিষার আবাদ করেছেন। চলতি মওসুমে তিন জেলায় প্রায় এক লাখ ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে আগাম ও নাবী জাতের সরিষার আবাদ হয়েছে। এ অঞ্চলের ফসলের মাঠগুলোতে এখন সরিষার হলুদ ফুলে ছেয়ে গেছে। মাঠের পর মাঠ জুড়ে বিরাজ করছে হলুদ ফুলের দৃষ্টিনন্দন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। সরিষার ফুল আকৃষ্ট করছে মৌমাছিসহ প্রকৃতি প্রেমীদের। গোটা অঞ্চল মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে। মৌচাষিরা মধু আহরনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আবহাওয়া অনুকুল থাকলে চলতি মওসুমে এ অঞ্চলে প্রায় তিন লাখ ৩০ হাজার টন সরষে ও দুই হাজার ২০০ টন মধু উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পাবনা জেলার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ঈশ্বরদী, আটঘড়িয়া, সুজানগর চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, লালপুর, সিংড়া, সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া, তারাশ, চৌহালী, রায়গঞ্জ, শাহজাদপুরসহ ২৬টি উপজেলায় চলতি রবি মওসুমে প্রায় এক লাখ ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে বিভিন্ন আগাম ও নাবী জাতের সরষে চাষ হয়েছে। সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রতি হেক্টরে দুই টন হিসেবে দুই লাখ হেক্টর জমিতে প্রায় তিন লাখ ৩০ হাজার টন। উল্লাপাড়া-তারাশ সড়কের দু’ধারে মাঠের পর মাঠ দৃষ্টিনন্দন মনোমুগ্ধকর থোকা থোকা হলুদ ফুলের চাদর বিছানো। সেই হলুদ ছুঁয়েছে দিগন্তরেখায়। চলতি মওসুমে সরষের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কৃষি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
পাবনা ও সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি রবি মৌসুমে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ দুটি জেলার চরাঞ্চলে প্রায় ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। নয়নাভিরাম সেই সরিষার ক্ষেতের আলে আলে এখন শুধুই সারিসারি মৌবাক্্র। আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় এবছর সরিষার আশাতীত ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে কৃষকেরা জানিয়েছেন।
সুজানগরের কৃষক রমজান আলী জানান, এক একর জমিতে সরষে চাষ করতে খরচ হয় এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। ভালো ফলন হলে প্রতি বিঘা ছয় থেকে সাত মন সরষে উৎপাদন হয়। প্রতি মন সরষের বাজার মূল্য দুই হাজার থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা। অন্যান্য ফসল আবাদ করে প্রতি বিঘায় যে পরিমান লাভ হয় তার চেয়ে ওই পরিমান জমিতে সরষে চাষ করে দ্বিগুণ লাভ করা যায়। এ অঞ্চলে সরষের আবাদ বৃদ্ধির সাথে সাথে বেড়েছে মওসুমি মৌচাষিদের তৎপরতা। সরষে যেমন দিচ্ছে তেল, সাথে দিচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এছাড়া সরষের ফুল ও পাতা ঝরে তৈরি হয় জৈবসার। ফলে কৃষকেরা এখন ধান ও অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি সরষে চাষের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছে। পাবনার হান্ডিয়াল এলাকার কৃষক ছলিম খা জানন, তিনি পাঁচ একর জমিতে সরষে আবাদ করে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছেন। সাত বছর ধরে সরষে চাষ করে তিনি প্রতি মওসুমে পৌনে দুই থেকে দুই লাখ টাকা লাভ করেছেন। চলতি মওসুমে আরো বেশি লাভের আশা করছেন বলে তিনি জানিয়েছেন।
মৌমাছির মৌ মৌ গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে গোটা বিলাঞ্চল। ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি উড়ে গিয়ে সরিষা ফুলে বসছে। কিছুক্ষণ পর পর মধু নিয়ে উড়ে এসে মৌমাছির দল ফিরছে মৌচাকে। চলতি মওসুমে যদি আবহাওয়া অনুকুল থাকে তাহলে তিন জেলায় দুই হাজার থেকে দুই হাজার ২০০ টন মধু আহরণের সম্ভাবনা রয়েছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রতি কেজি সর্বনি¤œ ২৫০ টাকা হিসেবে ৪৩ থেকে ৪৫ কোটি টাকা। এমনটিই আশা করছেন মৌচাষিরা। প্রায় এক মাস আগে বগুড়া, যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, সাতক্ষীরা, পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় সাড়ে সাত শতাধিক প্রশিক্ষিত মৌখামারি চলনবিলে অস্থায়ী আবাস গেড়েছেন। মৌচাষিরা সরষে ক্ষেতের আলে এক লাখ থেকে সোয়া লাখ মৌবাক্স বসিয়েছেন। প্রতি বছর নভেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সরষে ফুলের মধু আহরণ চলে। এ সময়ে গড়ে একেকজন মৌচাষি গড়ে দুই থেকে আড়াই টন মধু আহরণ করতে পারেন।
পাবনা আব্দুল আজিজ জানান, গত বছরের চেয়ে এবার প্রায় দেড়গুন মৌবাক্্র নিয়ে হাজির হয়েছেন বিভিন্ন জেলার মৌচাষিরা। মধু উৎপাদনে (পাবনা-নাটোর-সিরাজগঞ্জ) চলনবিল এক নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করেছে। প্রাকৃতিক উপায়ে মধু সংগ্রহের ফলে শুধু মৌচাষিরাই লাভবান হচ্ছেন, তাই নয়। মৌমাছির বিচরণে সঠিকভাবে সরষের ফুলে পরাগায়ন ঘটছে। তাতে সরষের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে গেছে অনেক। এতে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। শুধু তাই নয় পরিবেশবিদরা বলছেন, ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহার কম হওয়ায় উপকৃত হচ্ছে পরিবেশ। মৌমাছি শুধু মধুই সংগ্রহ করে না, ফসলের জন্য ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ মেরে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষকদের সহায়তা করে থাকে।
বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে মধু সংগ্রহের পরিমান প্রায় দেড় লাখ কেজি। প্রতি কেজি মধু অগ্রিম ২০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে মাঠ থেকে। এ অঞ্চলে উৎপাদিত মধুর গুণগত মান খুবই ভালো। এ জন্য ভারতের ডাবর কোম্পানী, ঢাকার প্রাণ, স্কয়ার, এপি, এসিআইসহ বিভিন্ন নামি-দামি ব্যান্ডের প্রসাধনী কোম্পানীর এজেন্টরা মাঠ থেকে অপরিশোধিত মধু অগ্রিম কেনা শুরু করেছে। সুন্দরবনের মধুচাষিরা এ অঞ্চলে মধু সংগ্রহ করতে এসেছেন। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে এখানে মধু সংগ্রহ পুরোদমে শুরু হয়েছে।
পুষ্টি বিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন জাহিদ জানান, আমাদের দেশে অতীত কাল থেকে মধু বহু রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। মধু পরিপাকে সহায়তা করে, ক্ষুধা বাড়ায়, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি, সর্দি, কাশি, জ্বর, হাপানি, হৃদরোগ, পুরনো আমাশয়, দাঁত, ত্বক, পেটের পীড়াসহ নানা জটিল রোগ নিরাময় করে থাকে। মধুতে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান ও ভেষজ গুণ রয়েছে। মধুর উচ্চমাত্রার ফ্রুক্টোজ ও গ্লুকোজ যা যকৃতে গ্রাইকোজেনের মজুত গড়ে তুলতে সাহায্য করে। এছাড়া মধু ভালো শক্তি প্রদায়ী খাদ্য। মৌচাষিরা জানিয়েছেন, বছরের সাত মাস মধু পাওয়া যায়। সরিষার পর লিচু, আম, ধনিয়া, তিলসহ বিভিন্ন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করা হয়।রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানান যায়, পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে সরিষার আবাদ ভাল হয়েছে। প্রাকৃতিক দূর্যোগ না হলে এবার সরিষার আশাতীত ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে।