শফিউল আযম ঃ
বাংলাদেশের তাঁতীদের তৈরি লুঙ্গির সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ববাজারে। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের ২০টি দেশে প্রতি বছর প্রায় দেড় কোটি পিস লুঙ্গি রফতানি হচ্ছে। এছাড়া ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের কাপড় ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ৩৪০ কোটি টাকা মূল্যের ৮৫ লাখ পিস লুঙ্গি কিনে দেশে নিয়ে যাচ্ছেন। পরে সেই লুঙ্গিতে নামিদামী প্রতিষ্ঠানের ষ্টিকার লাগিয়ে ভারতের লুঙ্গি হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানির মাধ্যমে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে বলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
সিরাজগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী শাহজাদপুর কাপড়েরহাটে ভারতের মালদাহর অজিত দত্ত, শিলিগুড়ির সেলিম খাঁন ও মুর্শিদাবাদের বাবু মিয়া জানিয়েছেন, বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবাংলার প্রায় দেড় কোটি লোক বিদেশে কাজ করছেন। তাদের চাহিদা পুরন করতেই মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, বাহারাইন, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কানাডা, ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ বিশ্বের ২০টি দেশে লুঙ্গি রফতানি হচ্ছে। বাঙালিরাই মূলতঃ এই লুঙ্গির ক্রেতা। ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশের লোকজন শখ করে বাংলাদেশি লুঙ্গি কেনেন।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশের লুঙ্গি ভারতে রফতানি শুরু হয়। তখন প্রতি মাসে চার ট্রাক লুঙ্গি (৬০ হাজার পিস) রফতানি হতো। ধীরে ধীরে চাহিদা ও রফতানি পরিমান বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালে ভারতের মালদাহর অজিত দত্ত, পাটনার তানভির আলম, শিলিগুড়ির সেলিম খাঁন, মুর্শিদাবাদের বাবু মিয়াসহ ১২ জন আমদানিকারক সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরহাট থেকে পাঁচ ট্রাক এবং টাংগাইলের করটিয়াহাট থেকে দুই ট্রাক লুঙ্গি কিনছেন। গড়ে প্রতিসপ্তাহে (সাত ট্রাক) এক লাখ পাঁচ হাজার পিস, সেই হিসেবে বছরে (৩৬৪ ট্রাক) ৫৪ লাখ ৬০ হাজার পিস লুঙ্গি তারা বাংলাদেশ থেকে কিনে তাদের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। পরে সেখানে তাদের প্রতিষ্ঠানের ষ্টিকার লাগিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি করে আসছে। লুঙ্গি রফতানিতে তারা একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করে চলেছে বলে জানা গেছে।
বেড়ার পাইকারী কাপড় ব্যবসায়ী শহিদ আলী জানিয়েছেন, ভারতের শান্তিপুর, সুমুদ্রগর, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, গঙ্গারামপুর, কলকাতা ও হওড়ার মিতুল দত্ত, সুব্রত সাহা, অজিত দত্ত, জগন্নথ হলদারসহ শতাধিক ব্যবসায়ী সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরহাট ও টাংগাইলের করটিয়াহাট থেকে প্রতি বছর (আরো প্রায় ২০০ ট্রাক প্রতি ট্রাকে ১৫ হাজার পিস) প্রায় ৩০ লাখ পিস লুঙ্গি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। পরে তারা সেই লুঙ্গি উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিন ২৪ পরগনা, মেদিনীপুর, হুগলী, বর্ধমান, নদীয়, মূর্শীদাবাদ, মালদহ, জলপাইগুড়ি, পশ্চিম দিনাজপুর, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিন দিনাজপুর, কুচবিহার, হওড়া ও হুগলীর নামিদামি শপিংমল, বিপনী বিতান ও ছোট-বড় পাইকার এবং রফতানিকারকদের কাছে বিক্রি করছেন।
সিরাজগঞ্জ ও পাবনা তাঁতী সমবায় সমিতি সূত্রে জানা যায়, পাবনা জেলার হাতিগাড়া, বনগ্রাম, সান্যালপাড়া, ছেঁচানিয়া, দোগাছি, সুজানগর, ড়েমরা, ঢহরজানি, সোনাতলা, পুন্ডুরিয়া, বিলসলঙ্গী, চাঁচকিয়া, কুলোনিয়া, হাটুরিয়া, রাকশা, মৈত্রবাধা, সাঁথিয়া, বাটিয়াখড়া, পেঁচাকোলা, ঈশ্বরদী, সিরাজগঞ্জের পুকুরপাড়, নগরডালা, ডায়া, খুকনী, শিবপুর গাছপাড়া ও নরসিংদী জেলার চরসুবুদ্ধি, হাইরমারা, নিলক্ষা, আমিরগঞ্জ, কাট্রাখালি, ঘোড়াদিয়া, করিমপুর, নজরপুর, বাবুরহাট, মাধবদী, পৌলানপুর, ভাটপাড়া ভাগীরথপুর, ঘোড়াশাল, পাইকশা, সনেরবাড়ী টাংগাইল জেলার পাথরাইল, চন্ডি, নলসুধা, চিনাখোলা, দেওজান, নলুয়া, হিঙ্গানগর, এলাসিন, বাতুলি, বাজিদপুর, বল্লা, রামপুরসহ তাঁত প্রধান এলাকার তাঁতে তৈরি লুঙ্গির সুনাম ও কদর এখন দেশের গন্ডি পেড়িয়ে বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
পাবনা বেসিক সেন্টার সূত্রে জানা যায়, দেশে ১৯৯৮ সালে বিদ্যুৎচালিত পাওয়ারলুমে লুঙ্গি তৈরি শুারু হয়। বার্তমানে এ ধরনের তাঁতে ৯০ ভাগই লুঙ্গি তৈরি হচ্ছে। এছাড়া চিত্তরঞ্জ ও পিটলুমে লুঙ্গি তৈরি হচ্ছে। আর উৎপাদিত লুঙ্গির বেশির ভাগই বিদেশে রফতানি হচ্ছে। পাবনা, সিরাজগঞ্জ, টাংগাইল ও নরসিংদী জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে লুঙ্গি প্রস্তÍুতকারক ও বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ হাজার। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান শুধু স্থানীয়ভাবে লুঙ্গি তৈরি ও বিক্রি করে থাকে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই তাঁত মালিকদের কাছে অর্ডার দিয়ে লুঙ্গি তৈরি করিয়ে আনে। পরে এসব প্রতিষ্ঠান নিজেদের প্রতীক বা ষ্টিকার লাগিয়ে ওই লুঙ্গি বাজারজাত করেন।
তাঁতীরা জানিয়েছেন, এক সময় নামে-বেনামে বিক্রি হওয়া লুঙ্গি এখন পরিচিতি পাচ্ছে কারখানার নিজস্ব ব্রান্ডে। দেশে প্রথম লুঙ্গি ব্রান্ডিং শুরু করে নরসিংদীর হেলাল অ্যান্ড ব্রাদার্স। বাজারে সোনার বাংলা টেক্্রটাইল, ডিসেন্ট, ইউনিক, ষ্ট্যান্ডার্ড, আমানত শাহ, রুহিপুরী, স্মার্ট, অমর, পাকিজা, এটিএম, বোখারী, ফজর আলী, অনুসন্ধান, জেএম, স্কাই, ওয়েষ্ট, রংধনুসহ ১২৫ ব্রান্ডের লুঙ্গি দেশের বাজারে বিক্রি হচ্ছে। তাঁত কারখানায় ৪০ থেকে ১০০ কাউন্টের সুতার লুঙ্গি তৈরি হচ্ছে। মান ভেদে প্রতি পিস লুঙ্গি ২২০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে লুঙ্গি বাজারে। রং ও ডিজাইনে বৈচিত্র্যের মাধ্যমে লুঙ্গি সবার কাছে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করতে কাজ করে যাচ্ছে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। লুঙ্গি এখন শুধু বাঙালি পুরুষের পোষাকই নয়, গুণ-মান এবং ভালো ডিজাইনের কারনে বাংলাদেশের লুঙ্গির দিকে নজর এখন বিদেশিদেরও। তবে বাংলাদেশি লুঙ্গির বড় ক্রেতা ভারতীয় ব্যবসায়ীরা। তারা বাংলাদেশ থেকে লুঙ্গি ভারতে নিয়ে সেখান থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ রফতানি করছে। এই লুঙ্গি তারা মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বাজারে প্রতি পিস এক হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ভারতের মালদাহ জেলার আমদানি ও রফতানিকারক এম এম এন্টরন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী অজিত দত্ত জানিয়েছেন, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ১২ জন আমদানি-রফতানিকারক বাংলাদেশের, আতাইকুলা, শাহজাদপুর, এনায়েতপুর, করোটিয়া ও বাবুরহাট থেকে লুঙ্গি কিনে সড়ক পথে ট্রাকে করে ভারতের পশ্চিমবাংলা, আসাম, ত্রিপুরা, বিহার ও দিল্লিতে নিয়ে মজুদ করে থাকেন। পরে সেখানে থেকে ভারতের বিভিন্ন নামিদামী প্রতিষ্ঠানের ষ্টিকার লাগিয়ে মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, লেবানন, ওমান, বাহারাইন, দুবাই, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কানাডা, ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি করে আসছে। ভারতীয় আমদানিকারকরা বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৭৫ লাখ পিস লুঙ্গি ক্রয় করে থাকে বলে তিনি জানান।
শাহজাদপুর হাটের পাইকারী কাপড় ব্যবসায়ী আব্দুল্লা আল মাসুদ জানালেন, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, টাংগাইলের করটিয়াহাট থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২৫ কোটি টাকার কাপড় কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। ভারতের বাজার পাওয়ায় এ অঞ্চলের তাঁত শিল্প কোন রকমে টিকে আছে।
ভারতের কলকাতার কাপড় ব্যবসায়ী গোপাল চন্দ্র সেন জানান, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ উৎপাদিত লুঙ্গি ভারতের রফতানিকারকদের প্রতিনিধিরা কিনে নিচ্ছে। ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের কাপড়ের দাম তুলনামূলক অনেক কম, টেকশই এবং উন্নত মানের হওয়ায় তারা এখান থেকে কাপড় কিনছেন। এই লুঙ্গি ভারতের উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিন ২৪ পরগনা, মেদিনীপুর, হুগলী, বর্ধমান, নদীয়, মূর্শীদাবাদ, মালদহ, জলপাইগুড়ি, পশ্চিম দিনাজপুর, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিন দিনাজপুর, কুচবিহার, হওড়া, কলকাতা, সুমুদ্রগর, শান্তিপুর, শুভরাজ, গঙ্গারামপুর, পাটনাসহ বড় বড় শহরে পাইকারি বিক্রয় করে থাকেন। এছাড়া ভারতের রফতানিকারকদের চাহিদা অনুয়ায়ী বাংলাদেশের কাপড় ব্যবসায়ীরাও লুঙ্গি সরবরাহ করে আসছে। তিনি জানিয়েছেন, ভারতের রফতানিকারকদের কাছে বাংলাদেশের লুঙ্গীর চাহিদা সব চেয়ে বেশী। তারা বাংলাদেশী লুঙ্গী মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি করে আসছে।
সোনার বাংলা টেক্্রটাইলের মালিক রফিকুল ইসলাম এ প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন, এখন ক্রেতারা লুঙ্গি কেনার ক্ষেত্রে ব্রান্ডকে প্রাধান্য দেয়। আর এ ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে সোনার বাংলা টেক্্রটাইল লুঙ্গি। ডিজাইন ও মানের কারনে সোনার বাংলা লুঙ্গি এগিয়ে রয়েছে, যা সব বয়সীর দৃষ্টি কাড়ছে। প্রতি বছর গড়ে ৭০ থেকে ৭৫ কোটি টাকার লুঙ্গি বিক্রি হচ্ছে।
পাবনা জেলা কেন্দ্রীয় শিল্প সমিতির সবেক চেয়ারম্যান মোঃ শাহজাহান আলী আশরাফী বলেছেন, কয়েক বছর ধরে সুতার অস্থিতিশীল বাজার, রং, কেমিক্যালসহ অন্যান্য উপকরণের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারনে লুঙ্গি তৈরির খরচ বেড়েছে। কিন্তু নানা প্রতিকুল পরিবেশের মধ্যে কয়েক বছর ধরে লুঙ্গি খাতের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশি লুঙ্গি রফতানি করে ব্যাপকভাবে লাভবান হচ্ছে। দেশের ব্যবসায়ীরা সরকারি সাহায্য, সহযোগীতা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে লুঙ্গি রফতানি করে বিশ্ববাজারে জায়গা করে নেয়ার পাশাপাশি বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ লুঙ্গি ম্যানুফ্যাকচারার্স, এক্্রপোর্ট অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েসন ও আমানত শাহ গ্রুপের চেয়ারম্যান মোঃ হেলাল মিয়া মোবাইল ফোনে জানিয়েছেন, গত বছর তার প্রতিষ্ঠান বেশ কয়েকটি দেশে লুঙ্গি রফতানি করেছে। প্রতি বছরই রফতানির পরিমান বাড়ছে। বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশের লুঙ্গির মান সবচেয়ে ভালো। রফতানিতে অনেক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। সরকারি সহযোগীতা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে তৈরি পোষাকের পর লুঙ্গি দিয়েই বিশ্ববাজারে নতুন জায়গা করে নেয়া সম্ভব বলে তিনি জানিয়েছেন।
শফিউল আযম