শফিউল আযম, বেড়া (পাবনা) সংবাদদাতা ঃ
পাবনা বেড়া উপজেলার জোয়ারে পদ্মা ও যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চরের নিন্মাঞ্চলের বাদাম ক্ষেত প্লাবিত হচ্ছে। চাষিরা ক্ষেত থেকে বাদাম তোলা ও শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন। চলতি মওসুমে পদ্মা ও যমুনার চরে প্রায় ৩৫০ হেক্টরে বাদাম এবং ২৫০ হেক্টর জমিতে তিল চাষ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে বাদাম ৫২৫ টন এবং তিল ৩৭৫ টন । চৈত্র মাসে কয়েক দফা বৃষ্টি হওয়ায় এ বছর বাদাম ও তিলের আশাতীত ফলন পাওয়া যাবে বলে সংশ্লিষ্ট চাষিরা জানিয়েছেন।
বেড়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে পাবনা জেলার পদ্মা ও যমুনা নদী বেষ্টিত বেড়া উপজেলার নয়নপুর, কল্যানপুর, চরপেঁচাকোলা, পেঁচাকোলা, চরআড়ালিয়া, সাঁড়াশিয়া, চরসাফুল্ল¬া, চরনাগদা, চরঢালা, চরকল্যানপুর, পূর্বশ্রীকন্ঠদিয়া, পদ্মারচরসহ ২০টি চরের ৩০০ হেক্টর জমিতে বাদাম চাষের লক্ষ্যমাত্র নির্ধারন করা হয়েছিল। গত মওসুমে বাদামের দাম ভাল পাওয়ায় চাষিরা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৫০ হেক্টরের বেশী জমিতে বাদাম চাষ করেছেন। এছাড়া চরে প্রায় ২৫০ হেক্টর জমিতে তিল আবাদ হয়েছে। তিল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩৭৫ টন।
বেড়া উপজেলার হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়নের নয়নপুর, পেঁচাকোলা ও সাঁড়াসিয়ার চর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, চরের দীগন্ত বির্¯Íীণ মাঠে যেদিকে চোখ যায় শুধুই সবুজের সমারোহ। বাদামের পাশাপাশি তিনটি চরের এবার পরীক্ষামূলকভাবে ১০০ বিঘা জমিতে তীলের আবাদ করা হয়েছে। যদি কোন প্রাকৃতিক দূর্যোগ না হয় তা হলে তিলের বাম্পার ফলন পাওয়া যাবে বলে সংশ্লিষ্ট চাষিরা জানিয়েছেন। নয়নপুর চরের চাষি জাহান মোল্লা জানান, নয়নপুর, পেঁচাকোলা ও সাঁড়াসিয়ার চরে এবার পরীক্ষামূলকভাবে তিলের আবাদ করা হয়েছে। তিন মাসের ফসল তিল ফাল্গুন মাসে রোপণ করতে হয়। প্রতি বিঘা জমিতে আধা কেজি বীজ ৮০ টাকা, হালচাষ এক হাজার ৫০০ টাকা, নিড়ানী ও কাঁটা বাবদ চার হাজার টাকা মোট পাঁচ হাজার ৫৮০ খরচ হয়। প্রতি বিঘায় গড়ে চার থেকে পাঁচ মণ তিল পাওয়া যায়। বর্তমানে হাট-বাজারে প্রতিমণ তিল বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার ৮০০ টাকা। নতুন তিল উঠতে এখনো মাস খানেক বাকী আছে। চরের চাষিরা আগামী বছর থেকে বাদামের সাথী ফসল হিসেবে তিল চাষ করবেনর্। এছাড়া তিলের ফুল ও পাতা ঝরে তৈরি হয় জৈবসার। এতে জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী ফসল আবাদে অল্প পরিমান সার প্রযোগ করে ভাল ফলন পাওয়া যায় বলে চাষিরা জানিয়েছেন।
এদিকে পদ্মা ও যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় চরের নি¤œাঞ্চলের বেশ কিছু বাদাম ক্ষেত ডুবে গেছে। কৃষি শ্রমিকরা জমি থেকে বাদাম তুলছেন। ফলন হয়েছে আশাতীত। কৃষাণি ও কিশোর-কিশোরিরা গাছ থেকে বাদাম ছাড়িয়ে স্তুপ করে রাখছে। প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষিরা জমি থেকে আর্দ্র বাদাম তুলে হাটে নিয়ে বিক্রি করছেন। জোতদার ও বিত্তবান চাষিরা বাদাম শুকিয়ে গোলাজাত করে রাখছেন। এছাড়া অফ সিজনে বেশি দামে বিক্রির আশায় অনেক ব্যবসায়ী বাদাম কিনে মজুত (বাধাই) করে রাখছেন।
বেড়া উপজেলার পেঁচাকোলা গ্রামের সাবেক মেম্বর মোঃ মানিক সরোয়ার ৭ বিঘা, নয়নপুর গ্রামের দোযম মোল্লা ১৭ বিঘা একই গ্রামের জাহান মোল্লা ৭ বিঘা জমিতে বাদাম আবাদ করেছেন। তারা জানান, তিন মাসের ফসল বাদামের বীজ বপণ করতে হয় ফাল্গুন মাসে। এবার বীজ বোপণের পর চৈত্র মাসে কয়েক দফা বৃষ্টি হওয়ায় বাদামের আশাতীত ফলন পাওয়া গেছে। প্রতি বিঘা জমিতে আর্দ্র বাদাম পাওয়া গেছে ১২ মন। রোদে শুকানোর পর পেয়েছেন মোট ছয় মণ। গত বছর একই পরিমান জমিতে বাদাম উৎপাদন হয়েছিল ১১ মন। শুকানোর পর পেয়েছিলেন পাঁচ মণ। এবার বাদোমের আশাতীত ফলন হয়েছে। অন্যান্য ফসল আবাদের চেয়ে বাদাম আবাদে পরিশ্রম ও খরচ অনেক কম পড়ে। তারা জানান, প্রতিবিঘা জমি হালচাষ ও বীজ রোপণে দুই হাজার টাকা, বাদাম বীজ চার হাজার টাকা, বাদাম তোলা শ্রমিক, কীট নাশক, পরিবহন বাবদ দুই হাজার টাকা মোট আট হাজার টাকা খরচ পড়েছে। চলতি মওসুমে বীজের দাম দ্বিগুন হওয়ায় প্রতি বিঘা জমিতে বীজ বাবদ দুই হাজার টাকা বেশি খরচ হয়েছে। এবছর চরের চাষিরা বাদাম বিক্রি করে বেশ লাভবান হবেন বলে তারা জানিয়েছেন।
নয়নপুর চরের বাদাম চাষি দোয়ম মোল্লা একই চরের চাষি জাহান মোল্লা, চরঢালারচরের আক্কাছ আলী, সাগর সরকার, পেঁচাকোলার চরের মোঃ মানিক সরোয়ার, শ্রীপুর চরের রতন দাস, হোসেন আলী, বাদশা মিয়াসহ বিভিন্ন চরের চাষিদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, এ বছর বাদামের ফলন ও দানা অনেক ভাল হয়েছে। এবার মওসুমের শুরুতে হাট-বাজারে প্রতিমণ আর্দ্র বাদাম ১৭০০ টাকা শুকনা বাদাম ২৮০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গত বছর মওসুমের শুরুতে প্রতিমণ শুকনা বাদাম বিক্রি হয়েছে দুই হাজার থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা দরে। মওসুম শেষে প্রতি মণ বাদাম বিক্রি হয়েছে চার হাজার ৫০০ টাকা দরে।
বেড়া উপজেলার নাকালিয়া ও নগরবাড়ীতে চরাঞ্চলের বাদাম ও তিলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিক্রির পাইকারি মোকাম। প্রতিদিন চরের চাষিরা নৌকায় করে নাকালিয়া ও নগরবাড়ী মোকামে বাদাম ও তিলসহ অন্যান্য কৃষিজপণ্য বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন। তারা কৃষিজপণ্য বিক্রি করে সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী কিনে নিয়ে যান। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা বাদাম ও তিল কেনার জন্য এই মোকামে আসেন। বদাম ও তিল কেনা-বেচার জন্য দু’টি মোকাম ২০-২২টি আরত গড়ে উঠেছে। ব্যবসায়ীরা স্থানীয় আরৎদারের মাধ্যমে বাদাম ও তিল কিনে এখান থেকে নিজ নিজ গন্তব্যে নিয়ে যান। আবার কিছু কিছু বড় ব্যবসায়ী বাদাম কিনে মেশিনে খোসা ছাড়িয়ে নিচ্ছেন। পরে সেই বাদামের দানা সেখান থেকে সরাসরি প্রাণ, আকিজ, স্কয়ারসহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা হচ্ছে।
বেড়ার নাকালিয়া বাজারের আরতদার রফিকুল ইসলাম জানান, সিরাজগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী ও কুষ্টিয়া জেলার চরাঞ্চলের চাষিরা বাদাম ও তিল বিক্রির জন্য নগরবাড়ী ও নাকালিয়া মোকামে আসেন। দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীরা তার আরতের মাধ্যমে বাদাম ও তিলসহ গম, মাসকালাই, খেসারী কিনে নিয়ে যান। অনেক সময় পরিচিত ব্যপারীদের বাঁকী দিতে হয়। তারা সময় মতো পাওনা টাকা পরিষোধ করেন। বাঁকী টাকা নিয়ে তাকে কোন অসুবিধায় পরতে হয়নি।
বেড়া উপজেলাকৃষি কর্মকর্তা রঞ্জন কুমার প্রামানিক বলেন, এ বছর বাদাম ও তিলের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। অনুকুল আবহাওয়া এবং সময়মতো বৃষ্টি হওয়ায় বাদামের বাম্পার ফলন এবং দাঁনা পুষ্ট হয়েছে। তিলেও ভাল ফলন পাওয়া যাবে বলে তিনি জানান।