লোকসানে খামারিরা, দুধের দাম প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে

0
6

শফিউল আযম বেড়া (পাবনা) : পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের ছোট-বড় চার শ’ বাথানের বিস্তীর্ণ গো-চারণভূমিতে উন্নতজাতের লক্ষাধিক গরু রয়েছে। এসব গরুর আয়ের উপর নির্ভরশীল প্রায় দেড় লাখ পরিবার। বাথান থেকে প্রতিদিন সংগ্রহ করা হচ্ছে প্রায় দুই লাখ লিটার খাঁটি তরল দুধ। এই দুধ সংগ্রহ করে প্রক্রিয়াজাত করা হয় বাঘাবাড়ী মিল্কভিটাসহ বিভিন্ন বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো দুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করার করাণে খামারি ও গরু পালনকারীরা দুধের ন্যায্যমূল্য পান না। অব্যাহত লোকসানের কারণে এখন খামারি ও চাষিরা তাদের গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন।
বাঘাবাড়ির খামারি জাকির হোসেন বলেন, প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দুধে ফ্যাট বা ননীর স্ট্যান্ডার্ড পরিমাপ করে দুধের দাম ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। তিনি চার স্ট্যান্ডার্ড ননীযুক্ত দুধ সরবরাহ করেন এবং প্রতি লিটারের দাম পান ৪৫ টাকা। খোলাবাজারে প্রতি লিটার দুধ বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা দরে। কম দামে দুধ বিক্রি করায় লোকসান গুনতে হচ্ছিল তাকে। ব্যাপক লোকসানে পড়ে তিনি তার খামারের শতাধিক গরু বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন আছে মাত্র চারটি গাভী। আগে তাদের সমিতির বাথান থেকে মিল্কভিটায় ৪৩-৪৪ ক্যান দুধ (প্রতি ক্যানে ৪০ কেজি) সরবরাহ করা হতো। এখন দুধের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩-৪ ক্যানে। তার মতো অনেক খামারিই তাদের খামারের গরুগুলো বিক্রি করে দিচ্ছেন। অনেক খামারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানে দুধ বিক্রি না করে বাইরের ব্যাপারীদের কাছে উচ্চমূল্যে দুধ বিক্রি করছেন।

একাধিক খামারিরা জানান, সরকারি দুগ্ধ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকারী সমবায়ী প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটাসহ বিভিন্ন বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান খামারিদের কাছ থেকে চার দশমিক শূণ্য স্ট্যান্ডার্ড ননীযুক্ত তরল দুধ বোনাসসহ ৪৩-৪৮ টাকায় কিনে সেই দুধ থেকে ননী বের করে নেয়। পরে তিন দশমিক ৫০ স্ট্যান্ডার্ড ননীযুক্ত তরল দুধ প্যাকেটজাত করে ৮৫ টাকা দরে বিক্রি করে। তবে ভোক্তা পর্যায়ে এ দুধ বিক্রি হচ্ছে প্রতি লিটার ৯০ টাকা থেকে ৯৫ টাকায়। প্রতি লিটার দুধ থেকে শূণ্য দশমিক ৫০ স্ট্যান্ডার্ড ননী তুলে ঘি তৈরি করা হয়। এতে প্রতি লিটার দুধে লাভ হয় ৩৫ টাকা। এছাড়া এক লিটার দুধ থেকে ৫০ টাকার (প্রায় ৪০ গ্রাম) ঘি উৎপাদিত হয়। সব মিলে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি লিটার দুধ থেকে শুধু লাভই করছে ৮৫ টাকা। অপরদিকে অব্যাহত লোকসানের মুখে পড়ে কৃষক ও খামারিরা গরু পালন ও দুগ্ধ উৎপাদন পেশাকে অলাভজনক মনে করছেন। বর্তমানে তারা (খামারিরা) প্রতি লিটার দুধের দাম আরো ১০ টাকা বাড়ানোর দাবি করছেন।

শতাব্দীর প্রাচীনকাল থেকে পাবনার এ অঞ্চলে চাষিরা ঐতিহ্যবাহী উন্নত জাতের (পাক-ভারতের হরিয়ানা এবং মুলতানি) গরু লালন-পালন করে আসছে। এ অঞ্চলের গো-সম্পদের ভবিষ্যৎ এবং গো-সম্পদকে অর্থকরী সম্পদে রূপ দিতে স্বাধীনতার পর বাঘাবাড়ীতে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী সমবায়ী প্রতিষ্ঠান বাঘাবাড়ী মিল্কভিটা কারখানা স্থাপন করা হয়। কিন্তু কালের আবর্তে মিল্কভিটার আওতাভুক্ত বিস্তীর্ণ গো-চারণভূমি এখন সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। তবুও ব্যক্তিপর্যায়ে খাস জমি এবং মিল্কভিটার নিয়ন্ত্রণাধীন বাথান অঞ্চল যেটুকু রয়েছে, তারও যথাযথভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না।
জানা যায়, গো-খাদ্যের উচ্চমূল্যের কারণে বাথানিরা আর পুষিয়ে উঠতে পারছে না। অনেকে বলছেন, মিল্কভিটা লাভজনক প্রতিষ্ঠানে দাঁড়ালেও বাথানিদের এখন আর লাভ নেই। এ কারণেই তারা দুধের মূল্যবৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন। তারা বলছেন, মানবসম্পদ উন্নয়নের মতো গো-সম্পদ উন্নয়নে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থাকতে হবে। তা না হলে এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী গো-সম্পদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।

জানা যায়, স্বাধীনতার আগে চলনবিল অঞ্চলের বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর, উল্লাপাড়া ও শাহজাদপুর উপজেলায় চার শ’ বাথানে প্রায় পাঁচ হাজার একর গো-চারণভূমি ছিল্। জাল দলিল ও ভুয়া পত্তনি নিয়ে এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা গো-চারণভূমিগুলো আত্মসাৎ করে নিয়েছে। শাহজাদপুর উপজেলা ভূমি অফিস জানায়, বর্তমানে গো-চারণভূমির পরিমাণ প্রায় এক হাজার ৪০০ একর। এর মধ্যে ফরিদপুর উপজেলায় প্রায় ১০০ একর খাস, শাহজাদপুর উপজেলায় সমর্পিত খাস ৭১২ দশমিক ৬৮ একর ও অর্পিত ৫৭৯ দশমিক ১৬ একর ভূমি গো-চারণ হিসেবে রয়েছে। মিল্কভিটা জানায়, তাদের নিয়ন্ত্রণে মাত্র ৮৫০ একর জমি রয়েছে। অবশিষ্ট ৫৫০ একর জমি ভুয়া দলিল ও পত্তনির মাধ্যমে একাধিক ব্যক্তি দখল করে নিয়েছে। সরকারি এই জমি উদ্ধারে আদালতে ছয়টি মামলা ঝুলে আছে।
শাহজাদপুর ভূমি অফিস আরো জানায়, ব্যক্তি মালিকানাধীন গো-চারণভূমির পরিমাণ প্রায় দেড় হাজার একর। অনেকে গো-চারণভূমিতে এখন বোরো আবাদ করছেন। যে কারণে গো-চারণভূমি আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। ফলে বিশাল এ গো-সম্পদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা অনিশ্চয়তা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here