সিরাজগঞ্জের চৌহালীর উমরপুর ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অনিয়ম দূর্নীতিসহ ধর্ষনের অভিযোগ

0
349

শফিউল আযম, বেড়া (পাবনা) সংবাদদাতা ঃ
সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অফিসের সামনে প্রকাশ্যে মহিলা ইউপি সদস্যের কান ছিঁড়ে ফেলে আলোরন সৃষ্টিকারী উমরপুর ইউপি চেয়ারম্যান মতিনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে নানা অনিয়ম, দুর্নীতিসহ মহিলা গ্রাম পুলিশকে যৌননির্যাতন করে চাকুরিচ্যুত করার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনার সুষ্ঠ বিচার চেয়ে স্থানীয় এমপি, দুদক, চৌহালী উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে ওই মহিলা গ্রাম পুলিশসহ আট জন ইউপি সদস্য লিখিত অভিযোগ করেছেন। চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন মন্ডল ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি হওয়ায় প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তার বিরুদ্ধে তদন্তে নানা টালবাহানা করছেন বলে অভিযোগকারীরা জানিয়েছেন।
অভিযোগে জানা যায়, সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলার উমরপুর ইউনিয়ন দুর্গম এলাকায় হওয়ায় চেয়ারম্যান আবদুল মতিন দীর্ঘদিন ধরে নিজের ইচ্ছে মতো ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। যমুনা নদী বেষ্টিত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এলাকা হওয়ার কারণে তিনি ইউনিয়ন পরিষদ দূনীতির আখড়ায় পরিনত করেছেন। এদিকে সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যথাযথ তদারকির অভাবে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে চলছে ব্যাপক লুটপাট। গত বছর ২০১৯ সালে ৪০ দিনের কর্মসূচিতে ৪৭১ শ্রমিকের প্রত্যেকের সঞ্চয়ের দুই হাজার টাকা হিসেবে মোট জমা নয় লাখ ৪২ হাজার টাকা আত্মসাত করেছেন। এছাড়া প্রতি বছরের হোল্ডিং ট্যাক্স, ট্রেড লাইসেন্স বাবদ আদায়কৃত অর্থের কোনো হিসার নেই। এদিকে ওই ইউনিয়নের ছয় নং ওয়ার্ডে নিয়োগপ্রাপ্ত গ্রাম পুলিশ সালমা খাতুনকে ধর্ষন করে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। এখন নানাভাবে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগে উল্লেখ রয়েছে।
ভুক্তভোগী মহিলা গ্রাম পুলিশ জানিয়েছেন, চেয়ারম্যান আবদুল মতিন মন্ডল আমাকে ইউনিয়ন পরিষদের অফিসে একা পেয়ে প্রায়ই ঝাপটে ধরতেন। একথা কাউকে বললে জানে মেরে ফেলার হুমকী দেয়া হতো। এছাড়া চাকুরি থেকে বাদ দেয়া হবে এমন ভয় দেখিয়ে জোড়পূর্বক দুই বার ধর্ষন করে। এরপর থেকে চেয়ারম্যান রাতে তার বাড়িতে থাকার জন্য প্রস্তাব দিলে আমার স্বামী ও পিতা মাতার অমতের কথা বলে রাজি হইনি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সে আমাকে জোড়পুবর্ক আবারো ধর্ষনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে আপত্তিকর ছবি তোলে এবং সাদা কাগজে সই রাখে। এ ঘটনায় আমি ইউএনও অফিস এবং থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। কিন্তু এতে কোন কাজ হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা তদন্ত করবেন বলে শুধু আশ্বাস দিয়ে আসছেন। ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ থানায় লিখিতভাবে জানানোয় চেয়ারম্যান আমাকে চাকুরিচ্যুত করে প্রাণনাশের হুমকী দিচ্ছে। এই ঘটনায় ইউএনও বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। তিনি তদন্ত করার কথা বলেছিলেন, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন তদন্ত করা হয়নি।
উমারপুর ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ভিজিডি কার্ডধারী ছালমা, কুলসুম, শহিদা, জহুরা ও আলেয়া খাতুন বলেছেন, গত ৭ মাস ধরে আমাদের ভিজিডি কার্ডের চাল না দিয়ে চেয়ারম্যান আত্মসাত করেছেন। এছাড়া সঞ্চয়ের কথা বলে জনপ্রতি ২০০ এবং অতিরিক্ত আরো ৫০ টাকা করে নিয়েছে। তবে সঞ্চয়ের কোন জমা রশিদ আমাদের দেয়া হয় নাই। এর আগে জনপ্রতি ২০ থেকে ২২ কেজি করে চাল দেয়া হয়েছে। কেন চাল কম দেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে আমাদের চেয়ারম্যান অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করেছেন।
উমরপুর ইউপি মেম্বার মোখলেছুর রহমান জানিয়েছেন, চেয়ারম্যান মতিন শুধু ভিজিডি ও ভিজিএফ এর চালই নয়, উপজেলা প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় করোনাকালীন সময়ে দুস্থদের জন্য বিশেষ বরাদ্দের চাল ও জিআর এর চাল আত্মসাত করেছে। এবিষয়ে চৌহালী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) অফিসে অভিযোগ করে কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। এছাড়া প্রায় ৪৫০টি ভিজিডি কার্ডের মধ্যে ৫০টি কার্ডের চাল কখনই দেয়া হয় না। অবশিষ্ট কার্ডধারীদের মাত্র ২০ থেকে ২২ করে চাল দেয়া হয়। এছাড়া মা ইলিশ ধরা থেকে বিরত থাকার জন্য প্রত্যেক জেলেকে দুই কিস্তিতে ৪০ কেজি করে ৮০ কেজি হিসেবে প্রায় ২০০ কার্ডধারী জেলেকে ১৬ হাজার কেজি চাল বরাদ্দ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে চেয়ারম্যান মতিন মন্ডল তার পছন্দের মাত্র কয়েকজন জেলেকে ভিজিএফ এর চাল দিয়ে ফটেশেসন করে অবশিষ্ঠ চাল আত্মসাত করেছেন। ওই ইউনিয়নের আট নম্বর ওয়ার্ডের জেলে পাক্কু মিয়া বলেছেন, আমি কার্ডধারী জেলে হয়েও গত চার বছর ধরে সরকার ঘোষিত খাদ্য সহায়তার কোন চাল পাইনি।
অভিযোগে জানা যায়, চেয়ারম্যান মতিন মন্ডলের নিজ বাড়ি ধপুলিয়া থেকে আড়কান্দি বাজার পর্যন্ত সড়কটি ৪০ দিনের কর্মসূজন কর্মসূচির শ্রমিক দিয়ে কাজ না করে অবৈধভাবে বাংলাড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করে সড়কটি নির্মান করা হয়েছে। এই নির্মাণ কাজ থেকে শ্রমিকদের বঞ্চিত করে বিপুল পরিমান টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এছাড়া চেয়ারম্যানের বাড়ি হতে ধুপুলিয়া বাজারঘাট পর্যন্ত সড়কটি সংস্কার ও নির্মাণে নানা খাতে একাধিক প্রকল্প দেখিয়ে লুটপাট করেছেন। এই সড়কে ৪০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচি, টিআর, কাবিখার বেশ কয়েকটি প্রকল্পের উন্নয়ন কাজ কাগজ কলমে দেখানো হয়েছে বাস্তবে যার কোন অস্তিত্ব নেই বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া ফটোসেশনের জন্য কয়েকজন মহিলা শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো ব্রিদাশুরিয়া গ্রামের দিন মুজুর তারা ভানু জানিয়েছেন, ৪০ দিনের কর্মসূচীতে শ্রমিকের কাজ করেছি। কাজের শুরুতে ভোটার আইডি কার্ডসহ ছবি নিয়েছে, কিন্তু চেয়ারম্যান আজ পর্যন্ত কোন টাকা দেয় নাই। টাকা চাইতে গেলে পাত্তা দেয় না, অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে।
এছাড়া চেয়ারম্যান আবদুল মতিন পরিষদের সদস্যদের সিদ্ধান্ত ছাড়াই বিভিন্ন সময় কার্যবিবরণী খাতায় সদস্যদের স্বাক্ষর জাল করে গভীর নলকূপ ও ভিজিডি দেয়ার কথা বলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা তুলেছেন। বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা ও হোল্ডিং কার্ড বিতরণ করে টাকা তুলে আত্মসাত করেছেন। জন্মনিবন্ধনের টাকা নিয়ম অনুয়ায়ী ব্যাংকে জমা দেয়া হয়নি। ইউপি সদস্যদের সাথে সব সময় খারাপ আচরণ করে থাকেন। ভিজিডি’র সদস্য বাছাইয়ের সময় মেম্বারদের উপস্থিত থাকতে না দেয়াসহ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছে।
গত বছরের ২৭ মার্চ চৌহালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসের সামনের প্রকাশ্যে চেয়ারম্যান আবদুল মতিন মন্ডলের সাথে মহিলা মেম্বার আলেয়া খাতুনের ভিজিডি কার্ডের ভাগভাটোয়ার নিয়ে বাগবিতন্ডা হয়। এর একপর্যায়ে চেয়ারম্যান ক্ষুব্দ হয়ে মহিলা মেম্বারকে বেধরক মারপিট করে। এতে তার বাম হাত ভেঙ্গে যায় এবং কানের লতি ছিড়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। এ ঘটনায় মহিলা মেম্বরের ছেলে মিলন পাশা বাদি হয়ে চেয়ারম্যানসহ তিন জনের বিরুদ্ধে সিরাজগঞ্জ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রে আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন।
এ দিকে ভাষা সৈনিক আবদুল মতিনের জন্মভুমি উমরপুর ইউনিয়নের ধুপুলিয়া গ্রামে হওয়ায় এলাকাবাসির উদ্যোগে নির্মীত ভাষা মতিন স্মৃতি পাঠাগার নির্মান করা হয়। কয়েক বছর আগে নদী ভাঙনে পাঠাগারের জায়গা বিলীন হলে ঘরটি সুযোগ বুঝে দখল করে ইউনিয়ন পরিষদের পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এই ঘরের উন্নয়নের নামে এলজিএসপিসহ বিভিন্ন প্রকল্প বরাদ্দ এনে টাকা আত্মসাত করার অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে এলাকার মানুষের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে। স্থানীয়রা দ্রুত পাঠাগারটি দখল মুক্ত করে চরের শিশু ও শিক্ষার্থীদের জ্ঞান চর্চার সুযোগ দানের দাবি জানিয়েছেন।
উমরপুর ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল মতিনের বিরুদ্ধে সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট এবং ধর্ষণের প্রতিবাদে মানববন্ধণ করেছেন এলাকাবসি। এছাড়া টিআর, কাবিখা, ভিজিএফ, ভিজিডিসহ বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম, দূনীতি ও লুটপাটের বিচার দাবিতে উমরপুর ইউনিয়ন পরিষদের আট জন মেম্বর স্থানীয় সংসদ সদস্য, দুদক, জেলা প্রশাসক ও ইউএনওসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।
ওই ইউপি’র আট জন মেম্বারের পক্ষে প্যানেল চেয়ারম্যান আবদুল হাকিম জানিয়েছেন, আমরা চাই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করেছি, তা সঠিকভাবে তদন্ত পূর্বক প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হোক। অন্যথায় আমরা ইউনিয়ন পরিষদের সকল মেম্বর চেয়ারম্যানের আব্দুল মতিন মন্ডলের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনতে বাধ্য হবো।
উমরপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন মন্ডলের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ইউপি মেম্বর এবং মহিলা গ্রাম পুলিশের লিখিত অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেছেন, মেম্বররা তার কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা আদায় করতে না পেরে অনিয়ম দূনীতির ভিত্তিহীন অভিযোগ এনেছে। এ ব্যাপারে সংবাদ সম্মেলন করেছেন বলে তিনি জানিয়েছেন। তবে মহিলা গ্রাম পুলিশের অভিযোগ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি নিরব থাকেন।
চৌহালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) দেওয়ান মওদুদ আহমেদ বলেছেন, উমরপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন মন্ডলের বিরুদ্ধে মেম্বরদের লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর আগে এক নারী গ্রাম পুলিশকে যৌনহয়রানির একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here