শফিউল আযম, বেড়া (পাবনা) সংবাদদাতা:উজান থেকে নেমে আসা ঢলে যমুনা নদী ফুলে ফেঁপে উঠেছে। সেই সাথে বেড়া উপজেলার ৫টি গ্রামে ভয়াবহ নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। নদী ভাঙনে বসতভিটা, মসজিদ, পলিট্রি ফার্ম, ফসলী জমি ও গাছপালা হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ। ভাঙন আতঙ্কে নদী পাড়ের মানুষদের নিদ্রাহীন রাত কাটাতে হচ্ছে। গত সোমবার থেকে শুরু হওয়া ভাঙনে ভাঙনে শতাধিক বসতভিটা, ফসলী জমিসহ অসংখ্য ফলদ ও বনজ বৃক্ষ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এদিকে চরাঞ্চলের বণ্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। যমুনার দূর্গম চরাঞ্চলের ৭টি গ্রামের ৭০০ শতাধিক বানভাসি পরিবার মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।
এদিকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাবনা প্রকল্প পরিচালক মোঃ শহিদুল ইসলাম, বেড়া উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের, উপজেলা নির্বাহী অফিসার আসিফ আনাম সিদ্দিকী, পৌর মেয়র আব্দুল বাতেন, বেড়া পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল হামিদ, বেড়া মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ শাহিদ মাহমুদ, প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। প্রকল্প পরিচালক শহিদুল ইসলাম জরুরী ভিত্তিতে ভাঙনরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য বেড়া পানি উন্নয়ন বিভাগের নিবাহী প্রকৌশলীকে নির্দেশ দেন। বেড়া পানিউন্নয়ন বিভাগ গত মঙ্গলবার থেকে চরপোঁচাকোলা, দক্ষিণ চরপেঁচাকোলা, মোহনগঞ্জ, পাইখন্দ, ঘোপসেলন্দা ও নটাখোলায় ভাঙন কবলিত এলাকায় বালুভর্তি জিও ব্যাগ নদীতে ফেলছে। ইতোমধ্যে ভাঙন অনেটা নিয়ন্ত্রনে এসেছে বলে স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।
যমুনার পশ্চিম পাড়ে পাবনার বেড়া উপজেলার হাটুরিয়া নাকালিয়া ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের চরপেঁচাকোলা, পৌর এলাকার ৯ নং ওয়ার্ডের পাইখন্দ, দক্ষিণ চরপেঁচাকোলা, মোহনগঞ্জ, রুপপুর ইউনিয়নের ঘোপসেলন্দা ও খানপুরা গ্রামে ভয়াবহ নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। যমুনার প্রচন্ড স্রোত ঘোপসেলন্দা ও খানপুরায় সরাসরি আঘাত করায় ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। ভাঙনে বসতভিটা, এলজিইডি’র পাঁকা সড়ক, ফসলী জমি, একটি মসজিদসহ অসংখ্য গাছপালা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলো বণ্যানিয়ন্ত্র বাঁধে ঠাঁই না পেয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে।
গত শনিবার (২০) জুলাই বেড়া পৌর এলাকার পাইখন্দ গ্রামে অদুরে হুড়াসাগর নদ ও যমুনা নদীর মোহনায় গিয়ে দেখা যায়, হুড়াসাগর নদের চেয়ে যমুনার পানির উচ্চতা বেশি। উজান থেকে প্রায় ৫০০ মিটার প্রস্তের যমুনার মুলধারা মোহনগঞ্জের প্রতিরক্ষা বাঁধে আছড়ে পড়ছে। সেখানে পানি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি ধারা ভাটির দিকে অপরটি উল্টো দিকে হুড়াসাগর নদের দক্ষিণপাড় ঘেষে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। পশ্চিম দিকে প্রবাহিত পানির ঘূর্ণায়মান স্রোতে তলদেশের লোলা মাটি কেঁটে গভীরতার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই গত মঙ্গলবার পাইখন্দ গ্রামের মোঃ জিন্দার মন্ডল, নজরুল মন্ডল, দুলাল মন্ডল, রব্বানী ও মকরমের বসতবাড়ীসহ গাছপালা দাবা ভাঙনে পানির গভীরে তলিয়ে যায়। এতে ওই গ্রামের মানুষের মাঝে দাবা ভাঙন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই ঘরদোর ভেঙে ও গাছপালা কেটে নিরাপদ স্থানে সড়িয়ে নিতে দেখা গেছে।
জানা যায়, গত ৪দিন ধরে দক্ষিণ চরপেঁচাকোলা গ্রামের সাবেক মেম্বর সামাদ মন্ডল, আরব আলী, গনি, বাবু, রহেল মোল্লা, কদ্দুস শেখ, সেলিম মোল্লা, সামাদ মোল্লা, শাহাদৎ মোল্লা, আরিফ, মোনা, আম্বিয়া, বিলকিস, শিল্পী খাতুন, আশকার, আন্চু, রজব আলী, হারুন, চাঁদ মন্ডলের বাড়ীসহ ২৮-৩০টি বাড়ী একই ভাবে পানির গভীরে দেবে গেছে। প্রতিদিনই ২-৩টি করে বসতভিটা দেবে পানির গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে চাঁদ মন্ডল, রশিদ মন্ডল, আনছু ও ইলমার পলট্রি ফার্ম নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের হুমকীর মুখে রয়েছে, শওকত, টিক্কা, গোলজার শিকদার, আনছার, নবী, ছালাম, এজে খাতুন ও জায়দা খাতুনসহ অনেকের বসতভিটা। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলো শুকনো খাবার ছাড়া কোন অর্থ সহায়তা না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন।
দক্ষিণ চরপেঁচাকোলা গ্রামের মৃত- দাউদ মন্ডলের ছেলে ৬০ বছর বয়সী জিন্দার মন্ডল জানিয়েছেন, সে তার জীবনে নিজ গ্রামে নদী ভাঙন দেখেননি। এমন কি বড় বড় বণ্যায় হুড়াসাগর নদের পানি যমুনায় মিলিত হয়ে ভাটির দিকে প্রবাহিত হতে দেখে আসছেন। এবারই প্রথম দেখলেন যমুনার প্রবাহ প্রতিরক্ষা বাঁধে আছড়ে পড়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি ¯্রােতধারা উল্টো দিকে হুড়াসাগর নদের উজানে প্রবাহিত হচ্ছে। ঘূর্ণায়মান স্রোতে চোখের পলকে ৫টি বসতভিটা ও গাছপালাসহ দেবে গভীর পানিতে তলিয়ে যেতে দেখেছেন। একই ভাবে গত ৪-৫ দিনে ২৮ থেকে ৩০টি বসতভিটা দেবে গেছে। মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ভাঙন আতঙ্কে গ্রামের মানুষদের নিদ্রাহীন রাত কাটাতে হচ্ছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
উপজেলার রুপপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান উজ্জল হোসেন জানিয়েছেন, তার ইউনিয়নের নটাখোলা ও ঘোপসেলন্দায় যমুনার ভাঙনে অব্যাহত রয়েছে। বসতভিটা, ফসলী জমি ও গাছপালা হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ। গত ক’দিনের ভাঙনে ২৮ থেকে ৩০টি বসতভিটা, একটি মসজিদ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর মাঝে শুকনো খাবার বিতরন করা হয়েছে। এসকল পরিবারের এখন নগদ অর্থ সহায়তা প্রয়োজন। এছড়া তার ইউনিয়নের দূর্গম চরাঞ্চলের পাগলা, কদমশরীফপুর, বামননগর, ভবানীপুর, দড়িশরীফপুর, কালিকাবাড়ী ও পাইকান্দি গ্রামের ৭০০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ত্রাণসামগ্রী বরাদ্দ না পাওয়ায় ওই সকল পরিবারকে ত্রাণসামগ্রী বা আর্থিক সহায়তা দেয়া সম্ভব হয়নি।
বেড়া পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল হামিদ বলেন, যমুনার ভাঙনরোধে জরুরী ভিত্তিতে ৬টি পয়েন্টে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ডাম্পিং করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে নদী ভাঙন অনেকটা নিয়ন্ত্রনে এসেছে। পুরোপরি ভাঙনরোধ না হওয়া পর্যন্ত বালুভর্তি জিও ব্যাগ ডাম্পিং অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
বেড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার আসিফ আনাম সিদ্দিকী বলেন, বণ্যা ও নদী ভাঙন পরিস্থিতি সার্বক্ষনিক মনিটরিং করা হচ্ছে। একটি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। পানি উন্নয়ন বিভাগ ভাঙনরোধে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ডাম্পিং করছে। বণ্যা ও নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।