উজানে পানি প্রত্যাহারের প্রভাবে পদ্মা ও তিস্তার শাখা-প্রশাখানদীগুলো পানিশুন্য হয়ে পড়ছে

0
360

শফিউল আযম ঃ
সেচ মওসুমে ভারত ফারাক্কা ও গজলডোবা ব্যারাজের মাধ্যমে পদ্মা ও তিস্তা নদীর পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এতে ভাটির বাংলাদেশ অংশে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় প্রমত্তা পদ্মা ও তিস্তা মরা নদীতে পরিনত হয়েছে। নদীর বুকে জেগে ঊঠছে অসংখ্য ছোট-বড় ধুধু বালুচর। নদী দু’টির শাখা-প্রশাখা ও উপনদীগুলো প্রায় পানিশুন্য হয়ে পড়ছে। এর ফলে দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাচ্ছে। নলকুপে পর্যাপ্ত পানি উঠছে না। সেই সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে আর্সেনিকের মাত্রা। এ অঞ্চলের কৃষি, মৎস্য, শিল্প ও ব্যবসা-বানিজ্যে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি অর্থনীতিকে ক্রমাগত পঙ্গু করে দিচ্ছে।
ভারত তিস্তা নদীকে কেন্দ্র করে গজলডোবার উজানে ২০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে মোট পাঁচটি ক্যানেল বা খাল খনন করেছে। এগুলো হলো, তিস্তা-মহানন্দা মূল ক্যানেল, মহানন্দা প্রধান ক্যানেল, ডাউক নগর প্রধান ক্যানেল, নাগর টাঙ্গন প্রধান ক্যানেল এবং তিস্তা-জলঢাকা প্রধান ক্যানেল। ‘তিস্তা-মহানন্দা মূল ক্যানেল’-এর সাহায্যে শুকনো মওসুমে তিস্তার প্রবাহ থেকে এক হাজার ৫০০ কিউসেক পানি মহানন্দা নদীতে নিয়ে যাচ্ছে। তিস্তা-মহানন্দা লিংক ক্যানেলের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬ কিলোমিটার। এই ক্যানেলের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৭৩ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। এর বিতরন খালের সংখ্যা ১০টি। এই সংযোগ খাল থেকে জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিম দিনাজপুর, কোচবিহার, মালদাহ জেলার কৃষি জমিতে সেচের পানি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ খালটির মধ্যে করলা, নিম, সাহু, করতোয়া ও জোড়াপানি নদী রয়েছে। এসব নদীর ওপর অ্যাকুইডাক্ট (কৃত্রিম পানিপ্রণালী) তৈরি করা হয়েছে। আধুনিক কারিগরিতে তৈরি অ্যাকুইডাক্টের নিচে বলে চলেছে নদী, ওপর দিয়ে খাল। মহানন্দা প্রধান ক্যানেলের দৈর্ঘ্য ৩২ কিলোমিটারের বেশি। এই ক্যানেলের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৭১ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। এর বিতরন খালের সংখ্যা ১৩টি। ডাউক নগর প্রধান ক্যানেলের দৈর্ঘ্য ৮০ কিলোমিটারের বেশি। এই ক্যানেলের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৯৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। এর বিতরন খালের সংখ্যা ১৮টি। নাগর টাঙ্গন প্রধান খালে দৈর্ঘ্য ৪২ কিলোমিটারের বেশি। এর মাধ্যমে বছরে এক লাখ ১৬ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। এর বিতরন খালের খংখ্যা আটটি। তিস্তা-জলঢাকা প্রধান ক্যানেলের দৈর্ঘ্য ৩০ কিলোমিটারের বেশি। এর মাধ্যমে ৫৮ হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। এর বিতরন খালের সংখ্যা ছয়টি।
গজলডোবা ব্যারাজের উজানে তিস্তা পানিতে ভরপুর থাকছে আর ভাটির বাংলাদেশ অংশ ধুধু বালুচরে পরিনত হয়েছে। এর প্রভাবে করতোয়া, চাওয়াই, পাঙ্গা, তীরনই, বেরং, রণচন্ডি, জোড়াপানি, পাথরাজ, সিঙ্গিয়া, ধরলা, দুধকুমার, সানিয়াজান, তিস্তা, ঘাঘট, ছোটযমুনা, নীলকুমার, বাঙ্গালী, বড়াই, মানস, কুমলাই, সোনাভরা, হলহলিয়া, জিঞ্জিরাম, বুড়িতিস্তা, যমুনেশ্বরী, মহানন্দা, টাঙ্গান, কুমারী, রতœাই, মহানন্দা, পূনর্ভবা, ত্রিমোহনী, তালমা, ঢেপা, কুরুম, কুলফি, বালাম, ভেরসা, ঘোড়ামারা, মালদহ, চারালকাঁটা, পিছলাসহ অনেক শাখা-প্রশাখা ও উপনদী শুকিয়ে গেছে। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর তিন থেকে পাঁচ মিটার পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। নলকুপে পর্যাপ্ত পানি উঠছে না। অন্যদিকে তিস্তায় পর্যাপ্ত পানি না পাওয়ায় দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা প্রকল্পে কাঙ্খিত সেচ লক্ষমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। তিস্তা সেচ প্রকল্প এলাকায় সাত লাখ হেক্টর জমিতে প্রতি বছর বোরো মওসুমে পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দেয়। এদিকে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের মিলিত প্রবাহের যমুনা নদী নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে। নদীর মুলধারা সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়েছে। যমুনা সংযুক্ত ২০টি নদী পানিশুন্য হয়ে পড়েছে। এতে কমেছে মাছ ও জলজ প্রাণী।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ফরাক্কা ব্যারেজের ভাটিতে মুর্শিদাবাদের জঙ্গীপুরে একটি ব্যারেজ তৈরি করা হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ৩৮ দশমিক ৩ কিলোমিটার ফিডার ক্যানেল। ফারাক্কা বাঁধ থেকে গঙ্গার পানি এই ক্যানেল পথেই ভাগীরথীতে পৌছে দেয়া হচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধ প্রকল্পের মাধ্যমে ভাগীরথী-হুগলি নদীর প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে ফিডার ক্যানেলে দৈনিক ৪০ হাজার কিউসেক পানি ছাড়া হয়। ভারত ফারাক্কার উজানে উত্তর প্রদেশ ও বিহারে সেচের জন্য আরো প্রায় ৪০০ পয়েন্ট দিয়ে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। এর বিরুপ প্রভাবে পদ্মা নদী শুকিয়ে মরা নদীতে পরিনত হয়েছে। পদ্মা সংযুক্ত অসংখ্য শাখা-প্রশাখা ও উনদী শুকিয়ে গেছে। ফলে এ অঞ্চলের কৃষি সেচ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
পদ্মার পানি দিয়ে শুস্কো মওসুমে রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর প্রভৃতি জেলায় সেচকাজ চালানো হয়। এ নদীর পানি দিয়ে প্রায় ২০ ভাগ জমির সেচকাজ চলে। বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বানিজ্য, নৌযোগাযোগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পদ্মা নদীর ভুমিকা গুরুত্বপূর্ণ। পদ্মার শাখা প্রশাখা ও উপনদী শুকিয়ে যাওয়ায় শিল্প, ব্যবসা-বানিজ্য ও কৃষি খাত ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে।
পদ্মা ও তিস্তা অসংখ্য শাখা-প্রশাখা ও উপনদীগুলো প্রায় পানি শুন্য হয়ে ধুধু বালুচরে পরিনত হয়েছে। অনেকে হেঁটেই পাড়ি দিচ্ছেন নদী। পদ্মা ও তিস্তা পাড়ে এখন গাঙচিল বেলেহাঁস আর ধবল বক দেখা যায় না। দৃষ্টিতে আসে না অন্যান্য পাখি। নদী দু’টিতে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় মাছ প্রায় শুন্য। যে কারণে সাদা বক গাঙচিল আর বেলেহাঁসের দেখা পাওয়া যায় না। এক সময় পদ্মা-তিস্তা ও এর প্রধান শাখা-প্রশাখা, উপনদীগুলোর সাথে জেলে পরিবারগুলোর জীবন-জীবিকা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিল। তারা আজ কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেকেই বাপ-দাদার এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশা শুরু করেছেন। আর মাঝি-মাল্লারা কর্মহীন হয়ে বেকার জীবনযাপন করছেন। খেয়া ঘাটের মাঝি জব্বার শেখ (৬২) বলেন, ‘পানি নাই নৌকা চলবো ক্যামনে, তাই হগোলেই হাঁইটা নদী পাড় হইতাছে। গড়াই পাড়ের জেলে অমল কান্তি হলদার জানান, পদ্মায় পানি নাই, তাই মাছও নাই। বেঁচে থাকার তাগিদে পেশা পরিবর্তন করে চালকল চাতালে দিনমজুরের কাজ করছেন।
পদ্মা নদীতে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় এর প্রধান শাখা নদী বড়াল ও আত্রাই নদী প্রায় পানি শুন্য হয়ে পড়েছে। জিকে প্রজেক্ট কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে। পদ্মা, মধুমতি, নবগঙ্গা, কাজলা, মাথাবাঙ্গা, আত্রাই, চিকনাই, হিনসা, কুমার, সাগরখালি, কপোতাক্ষ, চন্দনাসহ পদ্মার অসংখ্য শাখা-প্রশাখা নদীর বুকে জেগে উঠেছে ছোট-বড় অসংখ্য চর। কোন কোন স্থানে বালু স্থায়ী মৃত্তিকায় রুপ নেয়ায় ফসল আবাদ করেছেন অনেকেই। বর্তমানে পদ্মা নদী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ ব্রীজের নিচে খাস জমিতে কৃষক চিনা বাদাম, বাঙ্গী, তরমুজ, টমেটো, আখসহ নানা রকম রবি শস্য আবাদ করেছেন।
সরেজমিন পাবনার মধ্য দিয়ে পদ্মার আর একটি শাখা নদী মরা পদ্মা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে মূল পদ্মা, এবং পাবনার চাটমোহরে বড়াল, ছোট যমুনা, পূনভবা, আত্রাই, ইছামতি, গুমানী, গোমতী, ভদ্রবতী, গোহালা, নন্দকুজা, গাড়াদহ, কাকন, কাকেশ্বরী, সরস্বতী, মুক্তাহার ঝবঝবিয়া, ফুলজোর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এসব নদীর অস্তিত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। পদ্মা নদীতে পানির প্রবল টান পড়ায় এই সব নদী শুকিয়ে গেছে। কোন কোন স্থানে হাটু পর্যন্ত পানি আছে। এলাকার প্রবীণ লোকদের মতে, ফারাক্কা ব্যারেজের আগে এই সব নদ-নদীতে সারা বছর পানি থাকতো। অপর দিকে তিস্তা নদীতে পানি না থাকায় ব্রহ্মপুত্র নদে পানির টান পড়ায় যমুনা নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। যমুনা নদীর বুক জুড়ে অসংখ্য চর জেগে উঠেছে। নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় রাসায়নিক জ্বালানী তেল, রাসায়নিক সারসহ অন্যান্য পণ্যবাহী জাহাজ আন্ডারলোড নিয়ে বাঘাবাড়ী বন্দরে আসছে।
শুধুমাত্র ফারাক্কার প্রভাবে বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প-কারখানা সবকিছুতে মারাত্মক ক্ষতি করেছে। মিঠাপানি ছাড়া কৃষি তথা কোন ধরনের শিল্প-কারখানা চলতে পারে না। ফারাক্কার কারনে যশোর-খুলনা অঞ্চলে মিঠাপানির প্রবাহ কমে গেছে। পদ্মার তলদেশ ওপরে উঠে এসেছে। শুস্ক মওসুমে এখন পদ্মায় তেমন ইলিশ পাওয়া যায় না। মাছ আসার জন্য নদীতে যে পরিমান পানি প্রবাহ থাকার কথা সেটি না থাকায় এখন আর পদ্মায় ইলিশ আসে না। গাঙ্গেয় পানি ব্যবস্থায় দুইশতাধিক প্রজাতির মিঠাপানির মাছ ও ১৮ প্রজাতির চিংড়ি ছিল। সেগুলোর অধিকাংশই এখন বিলুপ্তির পথে। পদ্মা নদীতে পানি স্বল্পতার কারণে উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলে মরুকরণ অবস্থা স্থায়ী রুপ নিতে যাচ্ছে। জীববৈচিত্র্য অনেক আগেই হুমকীর মুখে পতিত হয়েছে।
পদ্মা সংযুক্ত বরেন্দ্র অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত মহানন্দা, নন্দকুজা, মুসা খাঁ, ভদ্রাবতী, সরস্বতী, ইছামতি, গুমানী, আত্রাই, ফুলঝোর, তুলসী, চেঁচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা, গোহালা নদী আত্রাই, বারনই, শিব, রানী, ছোট যমুনা নদীসহ ২২টি খাঁড়ি ও ৩৯টি বিলে এর বিরুপ প্রভাব পড়েছে। পাবনার ইছামতি, রতœাই, চন্দ্রাবতী এবং রাজশাহীর বড়ালসহ কয়েকটি নদী রয়েছে। এসব নদী-খাল পলি ও বালু জমে ভরাট হয়ে শুকিয়ে গেছে। ফলে এ অঞ্চলের কৃষির সেচ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃতিগত দিক দিয়ে নদী বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বুনিয়াদ। পেশাগত দিক থেকে জীবন-জীবিকার একটি অংশ নির্ভরশীল এ দেশের নদ-নদীর ওপর। এ দেশের কৃষি সম্পদ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যবসা-বানিজ্য, পরিবেশ- এর সবই নদীনির্ভর। অর্থাৎ নদীকে বাদ দিয়ে এদেশের উন্নয়ন তথা মানুষের জীবন-জীবিকা কল্পনাই করা যায় না। ভারত অভিন্ন নদ-নদীর পানি একতরফা নিয়ন্ত্রণ করছে। এর বিরুপ প্রভাবে গত চার দশকে দেশের উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি, মৎস্য, শিল্প ও ব্যবসা-বানিজ্যে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে, যা এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে ক্রমাগত পঙ্গু করে দিচ্ছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here