করোনার প্রকোপে তরল দুধের চাহিদা ও দাম কমেছে, বেড়েছে গোখাদ্যের দাম পাবনা-সিরাজগঞ্জের প্রায় দেড় লাখ খামারি লোকসানে

0
303

শফিউল আযম ঃ
করোনাভাইরাসের প্রকোপে তরল দুধের চাহিদা কমে যাওয়ায় বাঘাবাড়ী মিল্কভিটাসহ প্রায় ২০টি বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারি প্রতিষ্ঠান দুধ সংগ্রহের পরিমান কমিয়ে দিয়েছে। এতে পাবনা সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের প্রায় দেড় লাখ গো-খামারি ব্যাপক লোকসানে পড়েছেন। গত রমজান মাসে দুধের চাহিদা ও দাম বেড়ে যাওয়ায় আশার আলো দেখেছিলেন খামারিরা। ওই সময় দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারি প্রতিষ্ঠানগুলো খামারিদের কাছ থেকে আগ্রহের সাথে যেমন দুধ কিনেছেন, তেমনি খোলা বাজারে মিলেছে ভাল দাম। এমন অবস্থা ছিল ঈদুল ফিতরের পরে প্রায় ৭দিন। কিন্তু এখন আবার খামারিদের আগের দুঃসময় ফিরে এসেছে। চাহিদা কমে যাওয়ার কথা বলে প্রক্রিয়াজাতকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দুধ সংগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে। খোলা বাজারে খামারিদের লোকসান দিয়ে দুধ বিক্রি করতে হচ্ছে। এদিকে হঠাৎ করেই গোখাদ্যের দাম ব্যাপক বেড়ে যাওয়া খামারিদের কাছে ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দিয়েছে। অব্যাহত লোকসানে এ অঞ্চলের অনেক গো-খামার বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৭৩ সালের দিকে পাবনা জেলার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর এবং সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর ও উল্লাপাড়া উপজেলা নিয়ে দেশের সর্ববৃহৎ দুগ্ধ অঞ্চল গড়ে ওঠে। পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে প্রায় দেড় লাখের বেশি গো-খামার রয়েছে। এ ছাড়া গ্রামগুলোর প্রায় প্রতিটি বাড়ীতে গরু পালন করে দুধ উৎপাদন করা হয়।এ অঞ্চলে প্রতিদিন ১৫ থেকে সাড়ে ১৬ লাখ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। এরমধ্যে দেড় লাখ লিটার বাঘাবাড়ী মিল্কভিটা, আফতাব, আকিজ, ব্রাকসহ বিভিন্ন বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান চার লাখ ৫০ হাজার লিটার এবং প্রাণ এক লাখ লিটার দুধ ক্রয় করে সারা দেশে বাজারজাত করে আসছে। এ সব প্রতিষ্ঠানের দুধ সংগ্রহের পরিমাণ প্রতিদিন প্রায় ৭ থেকে ৮ লাখ লিটার। এছাড়া ঘোষেরা ৬০ থেকে ৭০ হাজার লিটার দুধ ক্রয় করে থাকে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অবশিষ্ট দুধ প্রক্রিয়াজাত করে বগুড়া, রংপুর, নাটোর, নওগাঁসহ বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করে থাকেন।
এই দুগ্ধ অঞ্চলকে টার্গেট করে প্রাণ, আকিজ, আফতাব, ব্রাক ফুড (আড়ং), অ্যামোফ্রেস মিল্ক, আড়ং দুধ (ব্রাক), মিল্ক ভিটা, ফার্মফ্রেস, রংপুর ডেইরি, ইছামতি ডেইরি, সেফ মিল্ক কোয়ালিটি, বিক্রমপুরসহ প্রায় ২০টি বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান দুধ সংগ্রহ করতে এ অঞ্চলে তাদের আঞ্চলিক ও শাখা দুগ্ধ সংগ্রহশালা স্থাপন করেছে। এরফলে তরল দুধের চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকে। সম্ভাবনাময় এই শিল্পকে কেন্দ্র করে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের হাজার হাজার পরিবার তাদের জীবিকার পথ হিসেবে গাভী পালন ও দুধের ব্যবসা বেছে নিয়েছেন। ফলে এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার গো-খামার। দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দুধ সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করে সারা দেশে বাজারজাত করে থাকে। এদিকে করোনার প্রকোপে তরল দুধের চাহিদা কমে যাওয়ায় সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দুধ ক্রয় কমিয়ে দিয়েছে। মিষ্ঠি ও চায়ের দোকানদাররা আগের তুলনায় চার ভাগের এক ভাগ কম দুধ কিনছেন। ফলে উৎপাদিত দুধ নিয়ে খামারিরা বিপাকে পড়েছেন। অনেক খামারি গ্রামে গ্রামে ফেরি করে দুধ বিক্রি করছেন।
গত প্রায় ১৫-২০ দিন হলো খামারিদের আবারও দুঃসময় ফিরে এসেছে। প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানসহ ছানা তৈরির কারখানাগুলো দুধ সংগ্রহ কমিয়ে দেয়ায় খামারিরা দুধ নিয়ে আবারও বিপাকে পড়েছেন। খোলা বাজারে ও কিছু ছানা তৈরির কারখানায় খামারিদের ৩০ থেকে ৪০ টাকা লিটার দরে দুধ বিক্রি করতে হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে দুধের দাম আরো কমে যাওয়ার আশঙ্কা করেছেন খামারীরা।
কিন্তু গত রমজান মাসে দুধের চাহিদা বাড়তে থাকে। প্রতিষ্ঠানগুলো খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। এমনকি দুধের সংগ্রহমূল্যও বাড়ানো হয়। এমনিতে প্রতিষ্ঠানগুলো ৪০ থেকে ৪২ টাকা লিটার দরে দুধ সংগ্রহ করে থাকে। গত রমজান মাসে বেসরকারি কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান ৪৫ থেকে ৫০ টাকা লিটার দরে দুধ সংগ্রহ করে। এ ছাড়া খামারিরা খোলা বাজারে ও ছানার কারখানায় এর চেয়ে বেশি দামে দুধ বিক্রি করতে থাকেন। ঈদুল ফিতরের পরে প্রায় সপ্তাহখানেক খামারিরা এমন দামে দুধ বিক্রি করেন। এভাবে দুধ বিক্রি করায় ও দুধের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় খামারিরা আশার আলো দেখতে থাকেন। অনেকেই মনে করেন দুঃসময় কেটে গিয়ে খামারিদের সুসময় ফিরে এসেছে।
দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দুধ সংগ্রহ কমিয়ে দিলেই এ অঞ্চলের দুগ্ধশিল্পে নেমে আসে বিপর্যয়। করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে খামারিরা উৎপাদিত দুধ নিয়ে মহা বিপাকে পড়ে যান। প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দুধ সংগ্রহ কমিয়ে দেয়ায় স্থানীয় বাজারে খামারিরা ১৫ থেকে ২০ টাকা লিটার দরে দুধ বিক্রি করেন। কোনো কোনো খামারি আবার ননি তুলে রেখে বাকি দুধ ফেলে দিতে বাধ্য হন।
দুগ্ধ প্রধান এলাকা সাঁথিয়া, ফরিদপুর ও শাহজাদপুর উপজেলার কয়েকজন খামারি জানিয়েছেন, ঈদুল ফিতরের পর দুধের দাম কমতে থাকলেও গোখাদ্যেও দাম উল্টো বেড়ে চলেছে। এক হাজার ২৫০ টাকা দামের ৩৭ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা ভুসির দাম ঈদুল ফিতরের পরে বেড়ে হয়েছে এক হাজার ৪২০ টাকা। ৩০০ টাকা মনের খরের দাম হয়েছে ৪০০ টাকা। খৈল, চিটাগুড়সহ সব ধরনের গোখাদ্যেও দামই এভাবে বেড়েছে বলে খামারিরা জানিয়েছেন।
বেড়া পৌর এলাকার বনগ্রাম মহল্লার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খামারি মাহফুজা মীনা বলেছেন, আমার খামারে প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ লিটার দুধ হয়। গত এক মাস ভালো দামে বিক্রি করার পর আবারও উৎপাদিত নিয়্যা বিপাকে পড়ছি। যে প্রতিষ্ঠানে আগে দুধ দিত্যাম তারা এখন আর নিতেছে না। বাধ্য হয়া স্থানীয় বাজারে কম দামে দুধ বেচা লাগত্যাছে।
সাঁথিয়ার আমাইকোলা গ্রামের দুধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান সেফ মিল্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ শেখ জানিয়েছেন, ‘করোনা দেখা দেয়ার পর আমাদের প্রতিদিন দুধ সংগ্রহ নেমে এসেছিল ৫০০ থেকে এক হাজার লিটারে। কিন্তু রমজান মাসে আমরা প্রতিদিন পাঁচ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠিয়েছি। তখন আমরা প্রতি লিটারের সংগ্রহ মূল্য ৫০ টাকার কাছাকাছি করেছিলাম। অথছ এখন প্রতি লিটার ৩৫ থেকে ৪০ টাকা মূল্যেও খামারিরা আমাদেও কাছে দুধ বিক্রির জন্য ধর্না দিচ্ছে। কিন্তু চাহিদা কমে যাওয়ায় এখন প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার লিটারের বেশি দুধ আমরা নিতে পারছি না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here