চলনবিলের কৃষিজপণ্য ও মৎস্যসম্পদ খুলে দিতে পারে সমৃদ্ধির দ্বার

0
383

শফিউল আযম ঃ
শত বছরের বিবর্তনে উত্তর জনপদের ঐতিহ্যবাহী মৎস্য ভান্ডার খ্যাত চলনবিল মরা খালে পরিনত হয়েছে। হারিয়ে ফেলেছে তার চিরচেনা রুপ, যৌবন আর ঐতিহ্য। শুস্ক মওসুমের আগেই বিল, নদী ও খাড়ি শুকিয়ে জেগে উঠেছে দিগন্ত বিস্তীর্ণ মাঠ। সেই মাঠে এখন রসুন, পেঁয়াজ, সরিষা, মিষ্টি কুমড়া, গাজর, লাউ, সীমসহ নানা প্রকার শাক-সবজি আবাদ হচ্ছে। এ অঞ্চলে উৎপাদিত শাক-সবজি, মধু, কাঁকড়া, শুটকি ও কুচিয়া মাছ ইংল্যান্ড আমেরিকা, মধ্যপ্রচ্যেসহ বিশ্বের অনেক দেশে রফতানি হচ্ছে। চলনবিলে উৎপাদিত কৃষিজপণ্য ও মৎস্যসম্পদ এ অঞ্চলের গ্রমীন অর্থনীতিতে গতির সঞ্চার করেছে।
বর্ষা মওসুমে চলনবিলে থৈই থৈই পানি চোখে পড়ে। আর বর্ষা শেষে সমগ্র বিলাঞ্চল থাকে শুস্ক। খাল খনন করে পানি নিস্কাশনের ফলে শুস্ক মওসুমে বিলে পানি চোখে পড়ে না। প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মাছের পরিবর্তে বিলে এখন অসংখ্য পুকুর কেটে বিদেশি হাইব্রিড মাছের সাথে কুচিয়া মাছ চাষ করা হচ্ছে। নদী বিল শুকিয়ে যাওয়া দিগন্ত বিস্তৃত জমিতে ধান, পাট, সরিষা, রসুন, পেঁয়াজ, তরমুজ, বাঙ্গি, মরিচ, গাজর, সীম, কপি, আলু, পটল, লাউসহ নানা প্রকারের ফসল আবাদ হচ্ছে। সবজির ব্যপারিরা প্রতিদিন এ অঞ্চলের অমৃতকুন্ডা হাট, মির্জাপুর হাট, ছাইকোলা হাট, মহিশলুটি হাটসহ ১২টি হাট-বাজার থেকে লাউ, আলু, সীম, বেগুন, গাজর, কপি, টমেটোসহ বিভিন্ন প্রকার শাক-সবজি কিনে ট্রাকে করে পাবনা, রাজশাহী, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়ে যাচ্ছেন। রফতানিকারকরা ঢাকা থেকে বিমানে সবজি আমেরিকা, ইংল্যান্ড, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, ইরাকসহ অনেক দেশে রফতানি করছেন।
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ৩৬৮ কিলোমিটার আয়তনের বিস্তীর্ণ চলনবিল অঞ্চল অর্থনৈতিক ভাবে হয়ে উঠতে পারে বিপুল সম্ভাবনাময়। এ অঞ্চলের উৎপাদিত মাছ, মধু এবং সরিষা ভোজ্যতেলের ঘাটতি পূরণে অনেকাংশে সক্ষম হয়েছে। পরিকল্পিত পদ্ধতিতে ইরি-বোরো ধানসহ অন্যান্য ফসল আবাদ করে দেশের খাদ্য ঘাটতি নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। চলনবিলে এখন বানিজ্যিকভাবে কুচিয়া মাছ চাষ করা হচ্ছে। এই কুচিয়া মাছ এবং কাঁকড়া চিনে রফতানি করা হচ্ছে। গবাদিপশু, হাঁসমুরগী, মৌমাছি পালন, শামুক, কাঁকড়া, চিংড়ি চাষের মাধ্যমে এ অঞ্চলের চাষিরা তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা আরো চাঙ্গা করে তুলতে পারেন। এ ভাবেই চলনবিল খুলে দিতে পারে সমৃদ্ধির অপার সম্ভাবনার দ্বার।
“ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া” বই থেকে জানা যায়, নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, নওগাঁ জেলার রানীনগর, আত্রাই, সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ, রায়গঞ্জ, উল্লাপাড়া, পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, বেড়া এবং বগুড়া জেলার দক্ষিণাঞ্চল মিলে চলনবিলের অবস্থান ছিল। কিন্তু ১৯১৪ সালে ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেল পথ স্থাপনের পর থেকে রেল পথের উত্তর ও পশ্চিম অংশকেই চলনবিল বলা হয়। এমএ হামিদ টি,কে ১৯৬৭ সালে ‘চলনবিলের ইতিকথা’ বইতে লিখেছেন, তখন থেকে প্রায় ১৪০ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৮২৭ সালে জনবসতি এলাকা বাদ দিয়ে চলনবিলের জলময় অংশের আয়তন ছিল ৫০০ বর্গমাইলের উপরে। ১৯০৯ সালে চলনবিল জরিপ কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, তৎকালে বিলের আয়তন ছিল ১৪২ বর্গমাইল। এর মধ্যে ৩৩ বর্গমাইল এলাকায় সারা বছর পানি জমে থাকতো। ওই রিপোর্টে বলা হয়, চলনবিল তার পানির স্রোতধারা ও নাব্যতা হারিয়ে ক্রমশঃ সংকুচিত হয়ে পড়ছে।
জানা যায়, গঠণকালে চলনবিলের আয়তন ছিল প্রায় এক হাজার আট বর্গকিলোমিটার। কিন্তু বর্তমানে বর্ষা মওসুমে আয়তন দাঁড়ায় প্রায় ৩৬৮ বর্গকিলোমিটার। শুষ্ক মওসুমে (মূল বিলটি) আয়তন দাঁড়ায় ১৫ দশমিক নয় থেকে ৩১ কিলোমিটার। প্রতি বছর চলনবিলের আয়তন হ্রাস পাওয়ায় বাড়ছে ফসলী জমি। জলবায়ু পরিবর্তন, অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে হারিয়ে যাচ্ছে মাছ ও জীববৈচিত্র। চলনবিলে জমির পরিমান প্রায় এক লাখ ৬৬ হাজার ৫৩৫ হেক্টর। বর্তমানে চলনবিল সঙ্কুচিত হয়ে নাটোরের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর এবং সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ ও রায়গঞ্জ নিয়ে চলনবিলের অবস্থান। মোট লোক সংখ্যা প্রায় ২০ লক্ষাধিক। চলনবিলে প্রায় এক হাজার ৭৫৭ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল, চার হাজার ২৮৬ হেক্টর আয়তন বিশিষ্ট ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট ২২টি খালসহ অসংখ্য ছোট-বড় পুকুর রয়েছে।
কার্তিক- অগ্রহায়ন মাসে চলনবিল অঞ্চলের পানি নেমে গেলে সমতল ভূমি জেগে ওঠে। তখন ওই সমতল ভূমি বা জমিতে চাষ হয় সরিষা, রসুন, কালাই, ধান, লাউ, কপি, আনাজ, গাজর, বেগুন, শসা, ক্ষিরাসহ নানা প্রকার রবি ফসল। এরপর এলাকার কৃষকেরা প্রস্তুতি নেয় বোরো ধান চাষে। পৌষ মাঘ মাসেই ধানের চারা লাগানোর কাজ শেষ হয়ে যায়। কৃষি উৎপাদনে সেচের জন্য কৃষকরা ব্যবহার করছেন ভূগর্ভের পানি। বৈশাখ মাসেই ধান কাটা শুরু হয়। শুধু ধানই নয়, অপেক্ষাকৃত উচু জমিতে আবাদ হয় নানা প্রকার শাক-সবজি। এ অঞ্চলের মাছ, সরিষা, মধু উৎপাদনসহ নানা প্রকার মওসুমি ফসল ফলছে। তবে উৎপাদিত পণ্যের যথাযথ সংরক্ষন ও বিপনন ব্যবস্থার অভাবে প্রতি বছর চাষিরা উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
মৎস্য চাষিরা জানিয়েছেন, দেশের সর্ববৃহৎ জলাভূমি চলনবিল এলাকার প্রায় ২০ লাখ মানুষ বছরের প্রায় পাঁচ মাস বেকার জীবনযাপন করেন। বর্ষাকালে এই এলাকার কৃষি জমি পানিতে ডুবে যায়। তাদের হাতে কোন কাজ থাকে না। এ সময় অনেকে মাছ ধরার পেশাষ আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু এক সময়ের মৎস্য ভান্ডর খ্যাত চলনবিলে এখন পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যায় না। এ অঞ্চলে ক্ষুদ্র কুটির শিল্প স্থাপন করে বেকারদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা হলে গ্রমীন অর্থনীতি নতুন জীবন পাবে। সেই সাথে উৎপাদিত কুঠির শিল্পজাত দ্রব্য জাতীয় অর্থনীতির বিকাশ সাধনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারবে।
চলনবিলের মাছের খ্যাতি দেশে বিদেশে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাছ উৎপাদন করে দেশে মাছের চাহিদা বহুলাংশে মেটানো সম্ভব। চলনবিল অঞ্চলে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কিংবা বিপণনের সুষ্ঠ ব্যবস্থা নেই। এ কারণে জেলেরা পানির দামে মাছ বিক্রি করতে বাধ্য হয়। বিলের মাছকে কেন্দ্র করে তারাশের মহিষলুটি ও নাটোরের সিংড়ায় মাছের আড়ৎ গড়ে উঠেছে। কিন্তু দালালদের কারণে জেলেরা মাছের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ অঞ্চলে মাছ সংরক্ষণের জন্য হিমাগার না থাকায় মৎস্যচাষিরা লাভবান হতে পারছেন না। মৎস্যভান্ডার খ্যাত এ অঞ্চলের বিভিন্ন পয়েন্টে ফিশ ল্যান্ডিং সেন্টার, ফিশ কোল্ডস্টোরেজ এবং বরফ উৎপাদন করখানা তৈরি করা যেত তাহলে মৎস্যচাষিরা তাদের মাছ সংরক্ষন করে উচ্চমূল্যে বিক্রি করতে পারতেন। সেই সাথে মাছ প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রফতানি করা সম্ভব হতো। চলনবিল অঞ্চলের শুঁটকি মাছের সুখ্যাতি এখন দেশে বিদেশে। শুঁটকি মাছ আধুনিক পদ্ধতিতে প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব হলে বিপুল পরিমান অর্থ উপার্জনের দ্বার উন্মোচিত হবে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বোরো মওসুমে চলনবিল অঞ্চলে বিপুল পরিমান ধান উৎপাদন করে দেশে খাদ্য ঘাটতি বহুলাংশে পূরণ করা সম্ভব। সুষ্ঠু পানি নিস্কাশন ও সেচের ব্যবস্থা, বাঘাবাড়ী-নিমাইচড়া বণ্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ পূনঃনির্মণ করা হলে চলনবিল অঞ্চলের কৃষকদের ধান উৎপাদনের পরিমান বাড়বে। এতে কৃষকরা ব্যাপক ভাবে লাভবান হবে। চলনবিলের কৃষকদের কৃষির পরেই জীবিকার অন্যতম উৎস হিসেবে ধরা হয় মাছ শিকারকে। কিন্তু একশ্রেণীর মধ্যস্বত্বভোগীদের দাপটে জলমহালের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিল পাড়ের প্রায় দেড় লাখ মৎস্যজীবীর জীবনে নেমে এসেছে চরম অনিশ্চয়তা। মৎস্যভান্ডার নামে পরিচিত চলনবিলে গড়ে ওঠেনি কোন হিমাগার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here