চলনবিলে মাছ সঙ্কটে শুঁটকি উৎপাদন ব্যহত লোকসানের আশঙ্কায় ব্যবসায়ীরা দিশেহারা

0
443

শফিউল আযম ঃ
পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোর জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে গঠিত মৎস্য ভান্ডার খ্যাত চলনবিলের প্লাবন ভূমিতে চলতি শুঁটকি মওসুমে তাজা মাছের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, ফসলী জমিতে অতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ, অবাধে মা মাছ শিকার এবং শুস্ক মওসুমে অধিকাংশ নদী-বিল-খাড়ির বেশিরভাগ এলাকা শুকিয়ে যাওয়ায় মাছের বংশ বিস্তার ও উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। চলনবিলে দেশি প্রজাতির মাছ ধরা ও শুকানোর এই ভরা মওসুমে অধিকাংশ শুটকি চাতালে তাজা মাছের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ফলে এবছর শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। এদিকে মহাজনের কাছ থেকে দাদনে টাকা নিয়ে শুঁটকি চাতালে বিনিয়োগ করে লোকসানের আশঙ্কায় চাতাল মালিকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
একটা সময় ছিল যখন চলনবিলের মাছ স্থানীয় অর্থনীতি ও জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলত। মাছ বিক্রি করে আর্থিকভাবে সচ্ছল হয় এ অঞ্চলের মানুষ। ১৯১৪ সালে চলনবিলের মাঝ দিয়ে প্রথম ঈশ্বরদী-সিরাজগঞ্জ রেল পথ নির্মিত হয়। তখন চলনবিলের সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ওই সময় ট্রেনে করে মাছ যেত কলকাতায়। স্বাধীনতার পরে ১৯৭৭ সালে চলনবিলের মাঝ দিয়ে বাঘাবাড়ী থেকে সিংড়া পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ নির্মান করা হয়। ২০০২ সালে চলনবিলের বুক চিরে নির্মান করা হয় ৫৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে বনপাড়া-হাটিকুমরুল-যমুনা সেতু সংযোগ সড়ক। চলনবিলে এক হাজার ৮৮ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে বেঁচে আছে ৩৬৮ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে মাত্র ৮৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় সারা বছর পানি থাকে। পানি সরে গেলে বিল-নদী-খাড়িগুলোর বেশির ভাগ এলাকা শুকিয়ে প্রজনন ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে হওয়ায় মাছের বংশ বিস্তার মারাত্মকভাবে ব্যহত হচ্ছে বলে স্থানীয় জেলেরা জানিয়েছেন।।
জানা গেছে, চলনবিলে মোট প্রায় ছয় হাজার ০৪৩ হেক্টর আয়তনের ৩৯টি বিল ও ১৬টি নদী এবং ১২০ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট ২২টি খাড়িসহ অসংখ্য পুকুর রয়েছে। বণ্যার পানি নেমে গেলে এসব বিল নদী খাড়ি শুকিয়ে হাজার হাজার হেক্টর সমতল ভূমি জেগে ওঠে। স্থানীয় কৃষকরা জেগে ওঠা জমিতে সরিষা, গাজর, রসসুর, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ফসল আবাদ করেন। ফসল আবাদে তারা মাত্রারিক্ত কীটনাশক প্রযোগ, জলবায়ু পরিবর্তন, নদীতে যত্রতত্র বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহ আটকে দেয়া, অবাধে মা মাছ নিধন, প্রজনন ক্ষেত্র সংকুচিত হওয়া এবং শুস্ক মওসুমে বিল-নদী-খাড়ি শুকিয়ে যাওয়ায় চলনবিলাঞ্চলে মাছের উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে।
দেশী মাছকে কেন্দ্র করে চলনবিলে গড়ে উঠেছে প্রায় ২৭০টি অস্থায়ী শুঁটকির চাতাল। গুরুদাসপুরের সাতগাড়ী গ্রামের ব্যবসায়ী কামাল উদ্দিন শুঁটকির চাতাল গড়েছেন তারাশের মহিষলুটি এলাকায়। তিনি জানান, গত বছর তার ২টি চাতালে এক হাজার ৩০০ থেকে এক হাজার ৪০০ মন শুঁটকি উৎপাদন হয়েছিল। সৈয়দপুর, নীলফামারীসহ বিভিন্ন এলাকার শুঁটকি ব্যবসায়ীরা এসে চাতাল থেকেই শুঁটকি মাছ কিনে নিয়ে যায়। তবে এ বছর চলনবিলের প্লাবন ভূমিতে মাছ ধরা পড়ছে কম। এরফলে তাড়াশের মহিষলুটির ৬টি চাতালসহ অধিকাংশ শুঁটকি চাতালে তাজা মাছের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে লাভ-তো দুরের কথা, চালান উঠানো যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন চাতাল মালিকরা।
পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোর মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মওসুমে ২৭০টি চাতালে প্রায় ৩৫ কোটি টাকা মূল্যের ৪০০ থেকে সাড়ে ৪০০ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে। সাড়ে ৪০০ মণ শুটকি উৎপাদনে প্রায় এক হাজার ৩৫০ মেট্্িরক টন কাচা মাছে প্রয়োজন। এদিকে চলতি শুঁটকি মওসুমে চলনবিলের প্লাবন ভূমিতে জেলেদের জালে পর্যাপ্ত পরিমান মাছ ধরা পড়ছে না। ফলে শুটকি উৎপাদনের এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বলে চাতাল মালিকরা জানিয়েছেন। তারা জানান, মওসুমের শুরুতে বড় বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে চাতাল তৈরি করেছেন। মাছের জন্য স্থানীয় জেলে ও ব্যবসায়ীদের অগ্রিম টাকা দিতে হয়েছে। তাদের সরবরাহ করা মাছ শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করেন, এ সময় বড় বড় ব্যবসায়ীরা সরাসরি চাতাল থেকে পছন্দের শুটকি মাছ কিনে নিয়ে যায়। শুঁটকি মাছ মান ভেদে ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ গ্রেডে বাছাই করা হয়। ‘এ’ গ্রেডের (ভাল মানের) শুঁটকি মাছ প্রক্রিয়াজাত করে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, ওমান, বাহারাইন, দুবাই, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হয়। সাধারনত এসব দেশে বসবাসরত প্রবাসী বাঙালিদের মাঝে রয়েছে চলনবিলের শুঁটকি মাছের আলাদা কদর।
তাছাড়া ‘সি’ ও ‘বি’ গ্রেডের শুঁটকি মাছ দেশের ভেতরে দিনাজপুর, সৈয়দপুর, রংপুর, রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা, নারায়নগঞ্জ ও চট্রগ্রামে উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়ে থাকে চলনবিলের শুঁটকি মাছ। সৈয়দপুরের শুঁটকি ব্যবসায়ী এখলাছ মিয়া জানান, চলনবিলের শুঁটকি মাছের মান ভালো। তাই দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলনবিলের মিঠা পানির শুঁটকি মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু এ বছর মাছের উৎপাদন কম হওয়ায় চাহিদার অর্ধেক শুঁটকি মাছও পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বিদেশে শুটকি মাছ রফতানি করা সম্ভব নাও হতে পারে বলে স্থানীয় ব্যসায়ীরা জানিয়েনে।
চলতি মওসুমে চলনবিলে প্রায় ২৫০টি অস্থায়ী চাতালে মাছ শুঁটকি করা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শুঁটকি তৈরির চাতাল মালিকরা এখানে আস্তানা গেঁড়েছেন। সাধারনত তিন থেকে ছয় লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে এ ব্যবসা শুরু করা যায়। পানি কমতে থাকালে চলনবিলের বিভিন্ন স্থানে জেলেদের জালে ধরা পড়ছে পুঁটি, নয়না, খলসে, চেলা, টেংরা, কই, মাগুর, শিং, বাতাসি, চিংড়ি, নলা, টাকি, গুচিবাইম, বোয়াল, ফলি, কাতল, লওলা, শোল, গজারসহ নানা জাতের মাছ। এসব মাছ কিনে নিজেরা চাতালে শুকিয়ে উৎপাদন করে শুঁটকি। পরে এই শুঁটকি পাঠানো হয়, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। কিন্তু এ বছর চলনবিলের প্লাবন ভূমিতে পর্যাপ্ত পরিমান মাছ না পাওয়ায় শুঁটকি চাতাল মালিকরা ব্যবসায়ীদের দাদনের টাকা কিভাবে শোধ করবে সেই চিন্তায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
জানা যায়, চলনবিলের প্রায় দুই সহ¯্রাধিক পরিবার শুঁটকি তৈরির কাজে জড়িত রয়েছেন। এসব পরিবারের নারী-পুরুষ সদস্যরা দিন হাজিরায় কাজ করছেন শুঁটকি চাতালে। কাজের ধরন অনুয়ায়ী তারা মজুরি পাচ্ছেন ৩৫০ থেকে সাড়ে ৪৫০ টাকা। এ কাজ করে তারা আর্থিকভাবে সচ্ছল হচ্ছেন। শুঁটকি তৈরির কাজে নিয়োজিত ননুয়াকান্দি গ্রামের সবিতা, তাহমিনাসহ বেশ কয়েকজন নারী ও পরুষ শ্রমিক জানান, তিন কেজি তাজা মাছ শুকিয়ে এক কেজি শুঁটকি তৈরি করা হয়। প্রকার ভেদে শুঁটকির বাজার মূল্য ৫০০ টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকা।
বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কের তাড়াশ উপজেলার মহিষলুটি শুঁটকি মোকামের একাধিক আরতদার জানিয়েছেন, এই মহাসড়ক নির্মানের আগে চলনবিল থেকে আহরিত বিপুল পরিমান মাছ অবিক্রিত থাকতো। এসব মাছ পরে শুঁটকি করা হতো অথবা ফেলে দেয়া হতো। তখন উদ্বৃত মাছ স্বল্প মূল্যে কিনে শুঁটকি তৈরি করে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে অনেক চাতাল মালিক আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। আর এখন উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠায় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা এসেছে চলনবিলের তাজা ও শুঁটকি মাছ কিনে ট্রাকে ভরে নিয়ে যান দেশের বিভিন্ন জেলায়। চলনবিলের দেশীয় প্রজাতির মাছের শুঁটকি তৈরির চাতালগুলো অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত চালু থাকে। মাছ রফতানিকারকরা শুঁটকি মাছ কিনে প্রক্রিয়াজাত করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি করছেন।
চলনবিলের শুঁটকি ব্যবসায়ীরা জানান, এ বছর চলনবিল অঞ্চলে মাছের উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। চাহিদামতো কাঁচা মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে শুঁটকি উৎপাদন অনেক কমে গেছে। শুঁটকি ব্যবসার সাথে যারা জড়িত এ বছর তাদের লোকসানের গুনতে হবে। দেশে-বিদেশে মিঠা পানির শুঁটকি মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ ব্যাপারে মৎস্য বিভাগ উদাসীন। শুঁটকি উৎপাদনকারীদের স্বল্প সুদে ব্যাংকঋণের পাচ্ছে না। ফলে তারা মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। অনেক সময় লোকসান দিয়ে শুঁটকি মাছ বিক্রি করে মহাজনের ঋণ পরিশোধ করতে হয়। শুঁটকি ব্যবসায়ে ঝুঁকি অনেক বেশি। ঠিকমতো শুঁটকির পরিচর্চা করতে না পারলে অনেক ক্ষেত্রে শুঁটকি নষ্ট হয়ে যায়। আর এ ধরনের সমস্যায় পড়লে মূলধন খোয়ানো ছাড়া কোন উপায় থাকে না। শফিউল আযম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here