চলনবিলে ৩৩ হাজার হেক্টরে রসুন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন

0
420

শফিউল আযম, বেড়া (পাবনা)/ মোঃ লুৎফর রহমান, তারাশ (সিরাজগঞ্জ) সংবাদদাতা: পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জের বির্স্তীণ অঞ্চল নিয়ে গঠিত চলনবিলে চলতি রবি মওসুমে মসলা জাতীয় ফসল রসুন আবাদ ও উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছে ৩২ হাজার ৭৬০ হেক্টর জমিতে। এ লক্ষ্যমাত্র গত বছরের চেয়ে সাত হাজার হেক্টর বেশি। বর্ষা শেষে বিল-নদী-খাঁড়ি থেকে পানি নেমে যাওয়ার পর চাষিরা বিণাচাষে রসুন বীজ রোপণ করেন। এবার বণ্যার পানি বিলম্বে নেমে যাওয়ায় রসুন আবাদ পিছিয়ে গেছে। এ অঞ্চলের ব্যাপকভাবে রসুন আবাদ বেড়ে যাওয়ায় কৃষি শ্রমিকের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। গত মওসুমের মাঝামাঝি সময় থেকে রসুনের দাম প্রায় চারগুণ বেড়ে যাওয়ায় এ অঞ্চলের চাষিরা রসুন চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। এতে আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

চলতি রবি মওসুমে নাটোর ও পাবনা জেলা রসুন আবাদের লক্ষ্য মাত্রা ধার্য হয়েছে ৩২ হাজার ৮৬০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে দুই লাখ ৬২ হাজার ৮৮০ টন। গত বছরে রসুনের আবাদ কম ও শিলাবৃষ্টিতে নষ্ট হওয়ায় বাজারে রসুনের দাম বেশী হয়েছে। অর্থৎ রসুনের দাম চারগুন হয়ে যায়। এবছর চলনবিল অঞ্চলের কৃষকরা রসুন আবাদে ব্যাপকভাবে ঝুঁকে পড়ায় লক্ষ্যমাত্র ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কৃষক ও কৃষি বিভাগ সূত্রে জানিয়েছে। চলনবিলের মাঠে মাঠে কৃষকেরা স্ত্রী-পুত্রদের সাথে নিয়ে রসুন চাষে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। এদিকে শ্রমিক সঙ্কটে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, চাকুরীজীবি, রিক্সাচালক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দোকানদারসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ নিজেরাই নিজ জমিতে রসুন বীজ রোপণ করছেন।

পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারন বিভাগ সুত্রে জানা যায়, দেশের উত্তরের চলনবিল অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি রসুন আবাদ হয়। এ অঞ্চলের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর, তাড়াশ ও রায়গঞ্জে রসুন অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসলে পরিণত হয়েছে। বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার পর কৃষকরা বিনা চাষে রসুন আবাদ করেন। এখন রসুনের বীজ রোপণের ভরা মওসুম চলছে। গত মওসুমে ভাল দাম পাওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষকরা এবার রসুন চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। তবে বিল-নদী-খাড়িরর পানি বিলম্বে নেমে যাওয়ায় রসুন আবাদ পিছিয়ে গেছে। এতে রসুনের ফলনে বিরুপ প্রভাব পড়তে পারে বলে কৃষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।

প্রাপ্ত তথ্য মতে, চলতি মওসুমে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলায় ১১ হাজার ৬০০ হেক্টরে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৯২ হাজার ৮০০ টন, গুরুদাসপুরে ৯ হাজার ৮০০ হেক্টরে ৭৮ হাজার ৪০০ টন, বাগাতিপাড়ায় এক হাজার ৪০০ হেক্টরে ১১ হাজার ২০০ টন, সিংড়ায় ৪০০ হেক্টরে তিন হাজার ২০০ টন, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও রায়গঞ্জে এক হাজার হেক্টরে ৮ হাজার টন, পাবনার চাটমোহরে ৮ হাজার ২০০ হেক্টরে ৬৫ হাজার ৬০০ টন, পাবনা সদর, সুজানগর, বেড়া, সাঁথিয়া, আটঘড়িয়া, ঈশ্বরদী, ফরিদপুর ও ভাঙ্গুড়া উপজেলায় ৪০০ হেক্টরে তিন হাজার ২০০ টন রসুন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এসব এলাকায় প্রতি বছরই রসুন আবাদের পরিমান বাড়ছে। চলনবিল অঞ্চলে বিনা চাষে রসুন আবাদ হয়। নাটোরের বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর এবং পাবনার চাটমোহর উপজেলায় সবচেয়ে বেশি রসুন আবাদ হয়ে থাকে।

মসলা জাতীয় ফসল রসুন উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত দেশের চলনবিল। এ অঞ্চলের সবচেয়ে বেশি রসুন আবাদ হয় বড়াইগ্রামের বাজিতপুর, মাড়িয়া, ইকড়ি, জালশুকা, তারানগর, শ্রীরামপুর, মানিকপুর, চকপাড়া, রয়না ভরট, মামুদপুর, রয়না, রোলভা, খাকসা, চড়ইকোল, গুরুদাসপুর উপজেলার ধারাবারিষা, কাছিকাটা, হাঁসমারী, দড়ি হাঁসমারী, শিধুলী, চড়কাদহ, মশিন্দা, চাটমোহর উপজেলার ছাইকোলা, কাটেঙ্গা, কোকড়াগাড়ি, ধানকুনিয়া, লাঙ্গলমোড়া, বরদানগর, ধুলাউড়ি, বোয়ালমারি, গৌরনগর, বিন্যাবাড়ি, নিমাইচড়া এলাকায়। চলনবিল অঞ্চলে বণ্যার পানি নেমে যাওয়ার পর পলিযুক্ত দোঁ-আশ ও এঁটেল দোঁ-আশ মাটি রসুন রোপন করা হয়।

তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৯৫-৯৬ সালে নাটোরের বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর উপজেলার সীমান্ত এলাকার গ্রামগুলোর কৃষকেরা স্বউদ্যোগে প্রথম বিনা চাষে রসুন আবাদের প্রচলন করেন। এই রসুনের আবাদ বা চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে বড়াইগ্রাম উপজেলার জালশুকা গ্রামের কৃষক খোরশেদ আলম পূর্ণি জানান, চলনবিল অঞ্চলের জমিতে সাধারণত কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসে নরম জমিতে বিনা চাষে রসুনের কোয়া রোপণ করা হয়। এ জন্য প্রচলিত নিয়মে জমি চাষ করার প্রয়োজন পড়ে না। এ পদ্ধতিতে ক্ষেতে আগাছা কম জন্মে। সার প্রযোগ করতে হয় কম। রোপণ থেকে উৎপাদণ পর্যন্ত ১২০ দিনের এই রসুন উৎপাদন খরচ তুলনামূলকভাবে পুরনো পদ্ধতির রসুন আবাদের চেয়ে অনেক কম। বিনা চাষ পদ্ধতিতে রসুনের ফলন বেশি হয়। প্রতি বিঘা জমিতে রসুনের ফলন হয় ২৫ থেকে ৩০ মণ। সাধারণত চৈত্র মাসে জমি থেকে রসুন তুলে আনা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নাটোরের লক্ষীকোল বাজার, রয়না ভরট হাট, মৌখাড়া হাট, জালশুকা হাট, চাঁচকৈড় হাট, চাটমোহরের অমৃতকুন্ডা হাট, মির্জাপুর হাট, ছাইকোলা হাট রসুন বিক্রির জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছে। রসুন বেচাকেনার জন্য বিভিন্ন হাট-বাজারে গড়ে উঠেছে অসংখ্য আড়ৎ। চট্রগ্রাম, সিলেট, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বেপারী আরৎদারের মাধ্যমে চাহিদা অনুয়ায়ী রসুন কিনছেন। পরে রসুন বস্তায় ভরে ট্রাকে করে সড়ক পথে নিজ নিজ গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বতমানে হাট-বাজারে মান ভেদে প্রতিমণ রসুন সাত হাজার থেকে সাড়ে সাত হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

বড়াইগ্রাম উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইকবাল আহমেদ বলেন, গত মৌসুমে রসুনের ভাল দাম পাওয়ায় চলনবিলের অঞ্চলের রসুন চাষীরা বেশ লাভবান হয়েছেন। এবার সবাই অন্য ফসল আবাদের চেয়ে রসুন চাষে বেশি ঝুঁকে পড়েছেন। ফলে এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি জমিতে রসুন আবাদ হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।

পাবনা কৃষি স¤প্রসারন অধিদফতরের উপপরিচালাক মোঃ আজাহার আলী জানান, দোঁ-আশ ও এঁটেল দোঁ-আশ মাটি রসুন চাষের জন্য বেশি উপযোগী। এ কারণেই নাটোর জেলায় বিশেষ করে বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর উপজেলায় সর্বাধিক জমিতে রসুন চাষ হয়। প্রতি বিঘা জমিতে ৩০ কেজি টিএসপি, ২৫ কেজি পটাশ ও ১৫ কেজি জিপসাম ছিটানোর দুই-একদিনের মধ্যে নরম জমিতে সারিবদ্ধভাবে রসুন বীজ রোপণ করতে হয়। রোপণের জন্য প্রতি বিঘা জমিতে দুই মণ রসুনের প্রয়োজন হয়। জমিতে রসুন রোপণের দিনই খড় বা বিচালী দিয়ে জমি ঢেকে দিতে হয়। বীজ রোপণের একমাস পরে পানি সেচ দিয়ে বিঘায় ১০ কেজি হারে ইউরিয়া ও পাঁচ কেজি হারে এমওপি ছিটিয়ে দিলে ফলন ভালো হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here