শফিউল আযম ঃ
সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলায় সড়ক ও জনপথ বিভাগের বাবলাতলা থেকে সম্ভুদিয়া সড়কের প্রায় ১৫ লাখ টাকার শতাধিক ইউক্যালিপটাসসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কাটা হয়েছে। বন ও সওজ বিভাগের অনুমতি না নিয়ে বিনা টেন্ডারে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানসহ তিনজন জনপ্রতিনিধির এই গাছ কেটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চৌহালী থানা পুলিশ একটি স’মিলে অভিযান চালিয়ে ২৫টি গাছের গুড়ি উদ্ধার করেছে। তবে এ ঘটনার সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ কোন ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সড়ক ও জনপথ বিভাগ প্রায় দেড়যুগ আগে চৌহালী উপজেলা সদরের সাথে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের যাতায়াত সুবিধার কথা বিবেচনা করে রেহাইপুকুরিয়া এলাকার বাবলাতলা থেকে সম্ভুদিয়া পর্যন্ত সড়ক নির্মান করে। পরে সড়কের উভয় পাশে বিভিন্ন ধরনের ফলজ, বনজ ও ঔষুধি গাছ রোপন করা হয়। দেড় যুগের ব্যবধানে চারা গাছগুলো বিশাল বিশাল গাছে পরিনত হয়েছে। সড়কের রেহাইপুখুরিয়া পশ্চিমপাড়া দেওয়ানগঞ্জ বাজার সংলগ্ন সড়কের পাশ থেকে করোনার এই সঙ্কটময় সময়ে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান নেতৃত্বে দুইজন ইউপি চেয়ারম্যান গত ১৫ দিনে প্রায় শতাধিক ইউক্যালিপটাস, মেহগুনি, নিমগাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে নিয়ে গেছে। গাছ কাটা শ্রমিকদের সর্দার মিটুয়ানীর বাবু মিয়া জানিয়েছেন, সে গাছ দেখাশোনার দায়িত্বে আছে। তাকে বাবলু চেয়ারম্যান দেখা শোনার দায়িত্ব দিয়েছে। অন্যান্য শ্রমিকরা বলেছেন, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যানের সাথে কথা বললেই সব জানতে পারবেন। এদিকে কেউ টের পাওয়ার আগেই বড় সাইজের সিংহভাগ গুড়ি সড়ক থেকে গোপনে বিক্রি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা যায়, যমুনার ভাঙ্গনে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা কথা বলে প্রায় দু’সপ্তাহ আগে চৌহালী উপজেলার রেহাইপুখুরিয়া বাবলাতলা থেকে সম্ভুদিয়া ও দেওয়ানগঞ্জ বাজার পর্যন্ত শতাধিক ইউক্যালিপটাস, নিম, মেহগুনিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এতে বনবিভাগ ও সওজের অনুমতি নেয়া হয়নি। চৌহালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার দেওয়ান মওদুদ আহমেদ ও চেয়ারম্যানদের পরামর্শে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মোল্লা বাবুল আক্তারের নেতৃত্বে বাঘুটিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল কাহহার সিদ্দিকী এবং খাষপুখুরিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ সরকার গাছ কাটার সাথে জড়িত রয়েছে। এদিকে সরকারী গাছ কাটার জন্য কোন টেন্ডার আহ্বান কিংবা গাছ গুলো নাম্বারিং করা হয়নি। পরিমাপ করা হয়নি গাছগুলো থেকে কি পরিমান কাঠ ও খড়ি পাওয়া যাবে। তারা ইচ্ছেমত গাছ কেটে বড় বড় গুড়ি অন্যত্র সরিয়ে কম ব্যাসের গুড়ি ও ডালপালা বিভিন্ন স্থানে স্তুপ করে রেখে দিয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত শনিবার দুপুরে চৌহালী থানা পুলিশের রেহাইপুখুরিয়া এলাকায় নুরু মিয়ার স’মিলে অভিযান চালিয়ে ২৫টি গাছের গুড়ি উদ্ধার করে। এসময় থানার এসআই আসাদ উদ্দিন জানান, রেহাইপুখুরিয়া নুরু মিয়ার স’মিলে প্রায় ২৫টি গাছের গুড়ি পাওয়া গেছে। এগুলো সিজার লিষ্ট করে থানায় জমা দেয়া হবে। ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সড়ক থেকে গাছ কেটে গুড়িগুলো চেয়ারম্যানের লোকজন স’মিলে রেখে গেছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গাছ কাটার সাথে জড়িত প্রভাবশালীরা ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার জন্য দোঁড়ঝাপ শুরু করেছে।
এ ব্যাপারে স’মিল মালিক নুরু মিয়ার সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে জানিয়েছেন, চেয়ারম্যানের লোকজন গাছের গুড়িগুলো তার স’মিলে রেখে গিয়েছিল। এবিষয়ে বাঘুটিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল কাহার সিদ্দিকী জানিয়েছেন, সড়ক ও জনপথ বিভাগের সড়কের গাছ কাটার সমস্ত হিসাব তাদের কাছে সংরক্ষিত আছে।
চৌহালী উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সাধারন সম্পাদক মোল্লা বাবুল আক্তার বলেছেন, যমুনা নদী ভাঙ্গনের আশঙ্কায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার দেওয়ান মওদুদ আহমেদ নির্দেশে জরুরী ভিত্তিতে গাছগুলো কাটা হয়েছে। করোনাকালের পরে টেন্ডার আহবান করা হবে। এই বিক্রির কোন সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করে বলেছেন, পুলিশ কর্তৃক গাছ উদ্ধারের বিষয়ে তিনি অবগত নন।
বনবিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত রেঞ্জার নিশিকান্ত’র সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেছেন, গাছ কাটার বিষয়ে কেউ তাকে অবগত করেনি। স্থানীয় বনকর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম তাকে জানিয়েছে, গাছগুলে সড়ক ও জনপথ বিভাগের। এজন্য বন বিভাগের করার কিছুই নেই। তবে গাছ কাটতে হলে একটি কমিটি গঠন করতে হয় এবং বিশেষজ্ঞের পরামর্শে প্রয়োজন হলে গাছ কাটা হয়। এ ক্ষেত্রে সে রকম কিছু করা হয়নি। তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন বলে জানিয়েছেন। স্থানীয় বনকর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম বলেছেন, গাছগুলো সড়ক ও জনপথ বিভাগের, এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।
সিরাজগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল ইসলাম পিকে জানিয়েছে, গত দু’সপ্তাহ আগে সংশ্লিষ্টরা ভাঙ্গনের আশঙ্কার কথা বলেছিল। পরবর্তীতে গাছ কেটে সংরক্ষনের বিষয়ে তাকে কেউ কিছু জানায়নি।
স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক নরেশ মধু বলেছেন, কোন জরুরী প্রয়োজন ছাড়া গাছ কাঠা উচিৎ না। তা ছাড়া যতদুর জানতে পেরেছি এই গাছগুলো খুবই মুল্যবান। শুধুমাত্র ভাঙনের আশঙ্কায় এ সব গাছ কাটা অন্যায়। তা ছাড়া করোনার এই সময়ে যে ভাবে গাছ কাটা হচ্ছে তা দু:খজনক। এই সময় আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন বেশী বেশী ‘অক্সিজেন’এর। আর আমরা এই ‘অক্সিজেন পাচ্ছি গাছ থেকে।
চৌহালী থানার ওসি রাশেদুল ইসলাম বিশ্বাস জানিয়েছেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে খবর পেয়ে গত শনিবার স’মিল থেকে ২৫ পিস ইউক্যালিপটাস গাছের গুড়ি জব্দ করে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা নজরুল ইসলামের জিম্মায় রাখা হয়েছে। গাছ কেটে গুড়িগুলো নির্দিষ্ট স্থানে না রেখে স’মিলে রাখার বিষয়টি সন্দেহজনক। এটি তদন্ত করে দেখা হবে।
চৌহালী উপজেলা নির্বাহী অফিসার দেওয়ান মওদুদ আহমেদ জানিয়েছেন, নদী ভাঙনে বিলীন হতে পারে এই আশঙ্কা থেকে গাছগুলো কেটে সংরক্ষনের জন্য চেয়ারম্যানদের সাথে পরামর্শ হয়েছে। তবে গাছের গুড়িগুলো স’মিলে নিয়ে রাখায় বিব্রতবোধ করছি। এর উদ্যোশে কি আসলে বুঝতে পারছি না।