চৌহালীতে ডাইং অ্যান্ড প্রসেস মিলের বিষাক্ত বর্জ্যে হুমকীর মুখে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ

0
366

শফিউল আযম ঃ
সিরাজগঞ্জের চৌহালীর খামারগ্রামেই অপরিকল্পিত ভাবে গড়ে উঠেছে ১১টি সুতা ডাইং অ্যান্ড প্রসেস মিল। এসব প্রসেস মিলে ব্যবহৃত কেমিক্যাল মিশ্রিত বিষাক্ত তরল বর্জ্য পরিশোধন না করে পাইপের সাহায্যে যমুনার শুকিয়ে যাওয়া একটি শাখা খালে ফেলা হচ্ছে। বর্তমানে সেখানে কৃষকেরা ধানের আবাদ করেছেন। ধান ক্ষেতের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া ওই শাখা খাল হয়ে বিষাক্ত তরল বর্জ্য যমুনা নদীতে গিয়ে পানিতে মিশছে। এতে দূষিত হচ্ছে নদীর পানি। এদিকে কারখানার বিষাক্ত তরল বর্জ্যরে পঁচা দুর্গন্ধে খামারগ্রাম, বেতিলসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ হুমকীর মুখে পড়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ জানা যায়, উপজেলার সদিয়া চাঁদপুর ইউনিয়নের খামারগ্রামে অবস্থিত প্রসেস অ্যান্ড ডাইং কারখানায় ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বা বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) স্থাপন করা হয়নি। মালিকরা পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর সুতা প্রসেসসহ রংয়ের কাজ অব্যাহত রেখেছে। যমুনা নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত খামারগ্রামের রহমান হাজীর ফিরোজা প্রসেস মিল, ইসলাম হাজীর ফিরোজা প্রসেস মিল, রফিকুল ইসলাম সেনার প্রসেস মিল, জাদুকর ছালামের প্রসেস মিল, ডায়না প্রসেস মিল, মনির ডাইং কারখানা, লাবু হাজীর প্রসেস মিল ও বেতিলের গণির ফিরোজা প্রসেস মিলসহ প্রায় ১১টি প্রসেস মিল অ্যান্ড ডাইং কারখানা গড়ে উঠেছে।
এছাড়া একই উপজেলার তাঁত শিল্প সমৃদ্ধ এনায়েতপুরে কয়েকটি সুতা রংয়ের কারখানায় সুতা মার্চরাইজ, ফিরোজা রংসহ বিভিন্ন ধরণের রং করা হচ্ছে। মার্চরাইজ ও সুতা রংয়ের কাজে এসিড, কস্টিক সোডা, ব্লিচিং পাউডারসহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। সুতা মার্চরাইজ ও রংয়ের কারখানার তরল বর্জ্যরে তীব্র পঁচা গন্ধ বাতাসে মিশে আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ায় জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ হুমকীর মুখে পড়েছে।
সরেজমিন খামারগ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, সুতা প্রসেস অ্যান্ড ডাইং কারখানায় কেমিক্যাল বর্জ্যের ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বা বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) নেই। নেই বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য কোন সংরক্ষিত হাউস। প্রসেস মিলের বয়লার ও ডাইং কারখানা থেকে পাইপের সাহায্যে দুষিত তরল বর্জ্য নির্গত হয়ে ধানের ক্ষেতের মাঝে যমুনা নদীর শুকিয়ে যাওয়া একটি শাখা নদীর সরু নালায় গিয়ে পড়ছে। সেখানে কৃষকেরা ধানের আবাদ করেছে। শাখা নদীর পূর্বপাড়ে বেতিল ও পশ্চিমপাড়ে খামার গ্রাম। ধান ক্ষেতের মাঝের নালা হয়ে বিষাক্ত তরল বর্জ্য যমুনা নদীতে গিয়ে পানিতে মিশছে। এতে নদীর স্বচ্ছ পানি বিবর্ণ হয়ে পড়ছে। অনেকেই নিরুপায় হয়ে ওই পানি ব্যবহার করছেন। এতে তারা চর্মরোগ, পেটেরপীড়াসহ নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কারখানার পাশের খালে রাসায়নিক মিশ্রিত তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। ওই তরল বর্জ্য ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে গিয়ে মিশছে। ফলে ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত হয়ে পড়ছে। ওই এলাকার বেশ কিছু অগভরি নলকুপে দুর্গন্ধযুক্ত পানি উঠছে। এছাড়া খালের আশপাশের গাছের পাতা হলুদ বর্ণ ধারন করে মরে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার জনিত ধোঁয়ায় কারখানাগুলোর পার্শ্ববর্তী বাড়িঘরের চালের টিনে হলদে আবরণ পড়েছে।
খামারগ্রামের কলেজ ছাত্র ইউসুফ আলী জানান, তার বাড়ির পাশে সুতা প্রসেস কারখানা থাকায় তাকে বিষাক্ত পরিবেশের বসবাস করতে হচ্ছে। তরল বর্জ্যরে ঝাঁঝাঁলো দুর্গন্ধযুক্ত বাতাসে এলাকার পরিবেশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করে কোন প্রতিকার পাওয়া যায় না। আবার কারখানা মালিকেরা প্রভাবশালী হওয়ায় অনেকেই তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পায় না। এ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে চাঁপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। কারখানা মালিকদের সাথে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ফলে এ সমস্যার কোন সমাধান হচ্ছে না।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এলাকার প্রভাবশালী প্রসেস অ্যান্ড ডাইং কারখানার মালিকরা স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর ধরে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এই ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে এসব প্রসেস মিল অ্যান্ড ডাইং কারখানার ব্যবসা। এলাকার সচেতন মহল অবিলম্বে এসব প্রসেস মিল অ্যান্ড ডাইং কারখানা জনবসতিহীন এলাকায় স্থানান্তরের দাবি জানিয়েছেন।
সিরাজগঞ্জ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর চৌহালীর এনায়েতপুরের খামার গ্রামের প্রকাশ শীল, সত্যবান মোদক, ওয়ালিউল্লাহ, নুরুন্নবী, রাশেদুল ইসলাম ও ময়ুরী খাতুনের বাড়িসহ তাঁত শিল্প অঞ্চলের বেশ কিছু নলকুপের পানির নমুনা সংগ্রহ করে রাজশাহী জোনাল ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করেছে। পরীক্ষায় পানিতে মারাত্মক ডিজল অক্সিজেন, মেঙ্গানিস, ফসফেট, শিশা, মাত্রাতিরিক্ত আয়রন ও আর্সেনিক পাওয়া গেছে। যা মানব শরীরের জন্য অত্যন্ত হুমকি স্বরুপ বলে কর্র্তৃপক্ষ জানিয়েছে। প্রসেস মিল অ্যান্ড ডাইং কারখানার আশপাশের বাডীর অগভীর নলকুপে দূগন্ধযুক্ত পানি উঠে আছে। বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় এই পানি তারা বাধ্য হয়ে পান করছে। এদিকে চৌহালীর খামারগ্রামে ১১টি প্রসেস মিল ও ডাইং কারখানার বিষাক্ত তরল বর্জ্য নদীতে ফেলায় দুষিত হচ্ছে পানি। এ কারনে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে জনজীবন, পরিবেশ ও জলজ প্রাণী।
এ বিষয়ে সদিয়া চাঁদপুর ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদুল ইসলাম সিরাজ বলেছেন, প্রসেস মিলের কেমিক্যাল বর্জ্য যমুনা নদীতে ফেলায় নদীর পানি ও পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। প্রসেস মিল মালিকেরা পরিকল্পিতভাবে বর্জ্য পরিশোধন করে নির্দিষ্ট স্থানে নিস্কাশন করলে দুষনের কবল থেকে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ যেমন রক্ষা পাবে, তেমনি প্রসার ঘটবে এলাকার তাঁত শিল্পের।
ফিরোজা প্রসেস মিলের মালিক ইসলাম হাজী মোবাইল ফোনে জানিয়েছেন, ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বা বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) স্থাপন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বর্তমানে কারখানার তরল বর্জ্য নিরাপদ স্থানে ফেলা হচ্ছে। এতে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতির কোন আশঙ্কা নেই বলে তিনি জানান।
মেডিসিন বিষেজ্ঞ ডাঃ মোঃ বদরুল হায়দার চৌধুরী বলেছেন, ডাইং অ্যান্ড প্রসেস মিলের তরল বিষাক্ত বর্জ্যের কারণে ভূগর্ভস্থ স্তরের পানিতে কলিফর্ম নামক জীবাণু জন্মায়। নলকুপের এই পানি খাওয়ায় এলাকার মানুষ চর্মরোগ ও পেটেরপীরায় আক্রান্ত হচ্ছে। এ ছাড়া লিভার, কিডনি, ফুসফুস, হৃদযন্ত্রসহ নানা ধরণের শাররীক সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
চৌহালী উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মোঃ জেরিন আহমেদ জানিয়েছেন, প্রসেস মিলের তরল বিষাক্ত ক্যামিক্যাল বর্জ্যরে কারনে মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হচ্ছে। এর প্রভাবে জমির সফল উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ক্ষেতের বিভিন্ন ফসলের চারা বড় হওয়ার আগেই কালছে রং ধারণ করে মরে যায়। এতে কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন।
চৌহালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেওয়ান মওদুদ আহাম্মেদ জানিয়েছেন, তিান ডাইং অ্যান্ড প্রসেস মিলের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ পাননি। ডাইং অ্যান্ড প্রসেস মিলগুলো সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখবেন। যদি দেখা যায়, সেগুলোর কারণে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করার কথা বলেছেন।
শফিউল আযম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here