পদ্মা-যমুনার চরে সরিষা ফুলের মধু ফুলেই শুকিয়ে যাচ্ছে মৌ চাষির অভাবে প্রায় আড়াই কোটি টাকার মধু ফুলেই শুকিয়ে যাচ্ছে

0
491

শফিউল আযম, বেড়া (পাবনা) সংবাদদাতা:পাবনা জেলার ফসলের মাঠে মাঠে এখন সরিষার হলুদ ফুলের সমারোহ। মাঠের পর মাঠ জুড়ে যেন হলুদের গালিচা বিছানো। থোকা থোকা হলুদ ফুল আকৃষ্ট করছে মৌমাছিসহ প্রকৃতি প্রেমীদের। দৃষ্টিনন্দন মনোমুগ্ধকর চোখ জুড়ানো এমন দৃশ্য দেখতে প্রকৃতিপ্রেমীরা সপরিবারে ভিড় করছেন মাঠে, অনেকেই ছবি তুলছেন। মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে দিগন্ত বিস্তৃত সরিষার ক্ষেত। পদ্মা-যমুনার চরাঞ্চলে মৌ চাষিদের অভাবে সরিষা ফুলের প্রায় আড়াই কোটি টাকার মধু ফুলেই শুকিয়ে যাচ্ছে।

পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি রবি মওসুমে পাবনা জেলায় ৩১ হাজার ৯৪২ হেক্টর জমিতে আগাম ও নাবী জাতের সরিষা চাষ হয়েছে। এরমধ্যে সদর উপজেলায় ছয় হাজার ৫০০ হেক্টর বেড়ায় দুই হাজার ২৬০ হেক্টর, সাঁথিয়া এক হাজার ৬০০ হেক্টর, সুজানগর, ৩ হাজার ৬৫০ হেক্টর, ঈশ্বরদীতে ৮০২ হেক্টর, আটঘড়িায় এক হাজার ৯০৫ হেক্টর, চাটমোহরে পাঁচ হাজার ৬১০ হেক্টর, ফরিদপুরে চার হাজার হেক্টর, ভাঙ্গুড়ায় পাঁচ হাজার ৬১৫ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে। তবে জেলার চরসাফুল্লা, চরপেচাকোলা, চরআড়ালিয়া, সাঁড়াশিয়া, কল্যানপর, চরসাফুলস্রা, চরনাগদা, চরঢালা, চরকল্যানপুর, পূর্বশ্রীকন্ঠদিয়া, পদ্মারচর, চাঁমতারা, শিংঘুলি, ভারদিঘুলিয়া, চরবলরামপুর, চরভাড়ারা, সাদিপুর, সুদিরাজপুর, আশুতোষপুরসহ ছোট বড় ৩০টি চরে সরিষার সবচেয়ে বেশি আবাদ হয়েছে।

আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে চলতি মওসুমে প্রতি হেক্টরে দেড় টন হিসেবে সরিষার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৪৮ হাজার টন ও ২৫০ টন মধু উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। মাঠ জুড়ে এখন দৃষ্টিনন্দন মনোমুগ্ধকর থোকা থোকা হলুদ ফুলের চাদর বিছানো। সেই হলুদ ছুঁয়েছে দিগন্তরেখায়। পদ্মা-যমুনা নদীর অববাহিকার প্রকৃতি কন্যা যেন হলুদ শাড়ী পরিধান করেছে। চরের সরিষা ক্ষেতে মৌমাছির গুণ গুণ শব্দ যেন প্রকৃতি কন্যান বিয়ের সানাইয়ে সুর তুলেছে। এদিকে পদ্মা-যমুনার চরাঞ্চলে মৌ চাষিদের অভাবে সরিষা ফুলের কোটি টাকার মধু ফুলেই শুকিয়ে যাচ্ছে।

যমুনা ও পদ্মা নদী বেষ্টিত উপজেলার নতুনভারেঙ্গা ইউনিয়নের কল্যানপুর চরের কৃষক আদম আলী প্রামানিক জানান, এক একর (তিন বিঘা) জমিতে সরিষা চাষ করতে খরচ হয় ১০ হাজার থেকে ১৩ হাজার টাকা। ভালো ফলন হলে প্রতি বিঘা ছয় থেকে সাত মন সরিষা উৎপাদন হয়। প্রতি মন সরিষার বাজার মূল্য দুই হাজার ১০০ থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা। অন্যান্য ফসল আবাদ করে প্রতি বিঘায় যে পরিমান লাভ হয় তার চেয়ে ওই পরিমান জমিতে সরিষা চাষ করে দ্বিগুণ লাভ করা যায়। সরিষা যেমন দিচ্ছে তেল, সাথে দিচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এছাড়া সরিষার ফুল ও পাতা ঝড়ে তৈরি হয় জৈবসার। ফলে কৃষকেরা এখন ধান ও অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি সরিষা চাষের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছেন। পাবনার সাঁথিয়ার সোনাতলা গ্রামের কৃষক আজিজার রহমান জানন, তিনি পাঁচ একর জমিতে সরিষা আবাদ করে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছেন। আট বছর ধরে সরিষা চাষ করে তিনি প্রতি মওসুমে দুই থেকে সোয়া দুই লাখ টাকা লাভ করেছেন। চলতি মওসুমে আরো বেশি লাভের আশা করছেন বলে জানিয়েছেন।

উরোপিয়ান হাইব্রীড এপিস মেলিফেরা মৌমাছির মৌ মৌ গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে গোটা চরাঞ্চল। ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি উড়ে গিয়ে সরিষা ফুলে বসছে। কিছুক্ষণ পর পর মধু নিয়ে উড়ে এসে মৌমাছির দল ফিরছে মৌবাক্সের। মৌমাছির বিচরণে সঠিকভাবে সরিষার ফুলে পরাগায়ন ঘটছে। তাতে সরিষার উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে গেছে অনেক। এতে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। শুধু তাই নয় পরিবেশবিদরা বলছেন, ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহার কম হওয়ায় উপকৃত হচ্ছে পরিবেশ। মৌমাছি শুধু মধুই সংগ্রহ করে না, ফসলের জন্য ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ মেরে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষকদের সহায়তা করে থাকে।

খুলনার মৌ চাষি জসিম সরদার জানান, পাবনা অঞ্চলে যে পরিমান সরিষার চাষ হয়েছে প্রয়োজনীয় সংখ্যক মৌচাষি থাকলে প্রায় পাঁচ কোটি টাকার মধূ সংগ্রহ করা সম্ভব। তার দু’টি গ্রুপে ৩৪০০টি মৌমাছির বাক্স আছে। প্রতিটি বাক্সে একটি করে রানী মৌমাছি রয়েছে। রানীর নির্দেশ মতো শ্রমিক মৌমাছিরা তিন কিলোমিটারের মধ্যে মধু সংগ্রহ করে। শ্রমিক মৌমাছি রানীর নির্দেশে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত মধু সংগ্রহ করে। তিনি বলেন, ৩৪০টি মৌ বাক্সে এক মাসে ১৫৪ মন মধু সংগ্রহ করা যাবে। যার বাজার মূল্য প্রায় ১৬ লাখ টাকা। পাবনা জেলার সমতল এলাকায় শতাধিক মৌ চাষির দল প্রায় ছয় কোটি টাকার মধু সংগ্রহ করেছে। শুধু মাত্র মৌ চাষির অভাবে পদ্মা যমুনার চরসাফুল্লা, চরপেচাকোলা, চরআড়ালিয়া, সাঁড়াশিয়া, কল্যানপর, চরসাফুলস্রা, চরনাগদা, চরঢালা, চরকল্যানপুর, পূর্বশ্রীকন্ঠদিয়া, পদ্মারচর, চাঁমতারা, শিংঘুলি, ভারদিঘুলিয়া, চরবলরামপুর, চরভাড়ারা, সাদিপুর, সুদিরাজপুর, আশুতোষপুরসহ ছোট বড় ৩০টি চরে সরিষা ফুলের প্রায় আড়াই কোটি টাকার মধু ফুলেই শুকিয়ে যাচ্ছে।

বগুড়া, রংপুর, নাটোর, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, খুলনা, টাংগাইল, যশোর, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রায় শতাধিক ভ্রাম্যমান মৌচাষি পাবনার প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। তাদের সংগৃহীত মধু রাজধানী ঢাকা, চট্রগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন কোম্পানি ও দোকানে বিক্রি হয়ে থাকে। আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় এবছর সরিষার আশাতীত ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে কৃষকেরা জানিয়েছেন।

সাতক্ষীরা থেকে সুজানগর উপজেলার গাজনার বিল এলাকায় মধু সংগ্রহ করতে আসা শিমুল বিশ্বাস বলেন, প্রায় পাঁচ বছর ধরে সে মধু আহরণ করছে। মাত্র কয়েক দিন হলো এখানে এসেছি। মনে হচ্ছে গত বারের চেয়ে অনেক বেশি মধু সংগ্রহ হবে। গত বছর দুই টন মধু আহরণ করেছিলেন, এবার আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় তিন টনের বেশি মধু সংগ্রহ করতে পারবেন। মৌচাষিরা জানান, বছরের সাত মাস বিভিন্ন প্রজাতির ফুল থেকে মধু পাওয়া যায়। সরিষার পর লিচু, আম, ধনিয়া, তিল-তিসিসহ বিভিন্ন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করা হয়। বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে মধু সংগ্রহের পরিমান প্রায় পাঁচ হাজার কেজি। প্রতি কেজি মধু ২৫০ টাকা দরে অগ্রিম বিক্রি হচ্ছে মাঠ থেকে। এ অঞ্চলে উৎপাদিত ভেজালমুক্ত মধুর গুণগত মান খুবই ভালো। এ জন্য ঢাকার প্রাণ, স্কয়ার, এপি, এসিআইসহ ব্যান্ড প্রসাধনী কোম্পানীর এজেন্টরা মাঠ থেকে অপরিশোধিত মধু অগ্রিম কিনে নেন। যশোরের মধুচাষি ইদ্রিস আলী বেড়ায় মধু সংগ্রহ করতে এসেছেন। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে এখানে পুরোদমে মধু সংগ্রহ শুরু হয়েছে।

সাঁখিয়া উপজেলার বিলসলঙ্গী মাঠে সরিষাক্ষেতে মধু সংগ্রহে সরঞ্জাম নিয়ে বসেছেন বগুড়ার আলেক আলী ও নাটোরের সানাউল হক। তারা জানান, মধু সংগ্রহ করে তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার কাহিনী। তাদের বাক্্েরর সংখা ৩৫২টি। প্রতি মন মধু ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা দরে বিক্রি করেন ঢাকার নবাবপুর ও যাত্রাবাড়ীতে। তারা বলেন, উন্নত প্রশিক্ষন আর সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে মধু সংগ্রহের কাজে উন্নতি করা যাবে। দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশে রফতানি করে বিপুল বৈদেশির মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।

পাবনা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোঃ আজাহার আলী বলেন, জেলা সদর, বেড়া, সাঁথিয়া, সুজানগর, ঈশ্বরদী, আটঘড়িা, চাটমোহর, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া উপজেলায় ৩১ হাজার ৯৪২ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে। চলতি বছর আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় জেলায় সরিষার আশাতীত ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে। গত বছর ফলন বাড়ানোর জন্য ক্ষেতের পাশে মৌ-বাক্স বসানো হয়েছিল। মৌমাছি পরাগায়ণে সহায়তা করেছে। ফলে সরিষার ফলন বেড়েছে। এ পদ্ধতিতে লাভবান হয়েছেন কৃষক ও মৌ ব্যবসায়ী উভয়েই। এছাড়া এ বছর ডাল জাতীয় ফসলের ভাল ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে।
বেড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মেঅঃ মসকর আলী জানান, পদ্মা ও যমুনার চরের মাটি বেলে, দো-আঁশ হওয়ায় পানি ধারণের ক্ষমতা কম। মাটির পানি ধারণক্ষমতা কম হলে জৈব সারের প্রয়োজন হয়। সরিষা চাষ করলে খাবার তেলের চাহিদা পূরণসহ পাতা ও ফুল ঝড়ে পড়ে জৈবসার তৈরি করে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here