শফিউল আযম ঃ
দেখলে মনে হবে মাঠের পর মাঠজুড়ে কেউ সোনালি গালিচা বিছিয়ে রেখেছে। বাতাসে কাঁচা-পাঁকা ধানের শিষ দোলা খাচ্ছে। সোনা রাঙা ধানের ওপর রোদ পড়ে চিকচিক করছে। কিন্তু সোনালি ফসলের ক্ষেতের এই ছবির সাথে কৃষকের মুখচ্ছবির কোন মিল নেই। বোরো ধানের দাম কমে যাওয়ায় পাবনার কৃষকের মুখের হাঁসি ম্লান করে দিয়েছে। কৃষিনির্ভর গ্রামীন অর্থনীতিতে পড়ছে বিরুপ প্রভাব।
সরেজমিন বিভিন্ন এলাকার মাঠ ঘুরে দেখা যায়, সোনালি ধানের শিষ বাতাসে দোলা খাচ্ছে। যতদুর চোখ যায় শুধু ধানের ক্ষেত। ছড়ায় ছড়ায় দুলছে সোনা রাঙা পাঁকা ধান। নতুন ধানের মিষ্টি ঘ্রাণে এখন ম ম করছে মাঠ। এ অঞ্চলে চলছে আগাম জাতের ধান কাটা ও মাড়াই। সম্প্রতিক ঘুর্ণিঝড় ফনীর প্রভাবে পাবনার ৯টি উপজেলায় বোরো ধানের তেমন কোন ক্ষতি হয়নি বলে কৃষকেরা জানিয়েছেন।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, পাবনা জেলায় এবার প্রায় ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর ধানের আবাদ হয়েছে। হেক্টর প্রতি ধানের ফলন চার দশমিক পাঁচ ও চালের ফলন দুই দশমিক সাত মেট্রিক টন ধরা হয়েছে। সে হিসেবে এবছর জেলায় দুই লাখ ৯২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ধান ও এক লাখ ৭৫ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। এ অঞ্চলে এখন আগাম জাতের ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ চলছে। এদিকে কৃষি শ্রমিকের সঙ্কট দেখা দেয়ায় স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা বাধ্য হয়ে ধান কাটতে মাঠে নেমে পড়েছে। আগামী দুই-এক সপ্তাহের মধ্যে ধান কাটা ও মাড়াই পুরোদমে শুরু হবে। এ বছর জেলায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। ফলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে বলে কৃষি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাবনা জেলায় বোরো ধানের দাম কমে যাওয়ায় কৃষকদের মাঝে চরম হতাশা বিরাজ করছে। এ অঞ্চলের আতাইকুলা, বনগ্রাম, কাশিনাথপুর, চতুরহাট, ডেমরা, ধুলাউড়ি, বোয়াইলমারিসহ বিভিন্ন হাটে নিয়মিত যাতায়াত করেন এমন কয়েকজন ব্যাপারির সাথে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে হাটগুলোতে প্রকারভেদে প্রতিমণ মোটা জাতের বোরো ধান ৫০০ টাকা ও বোরো চিকন ধান ৬৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে হাট ধানের চাহিদা নেই, ক্রেতা কম। ধানের বাজার দর নিয়ন্ত্রন করছে ফড়িয়া ও দালালেরা। ক্রেতার অভাবে চাষিরা কম দামে ফড়িয়া ও দালালদের কাছে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। বর্তমান বাজার দরে ধান বিক্রি করে চাষিদের প্রতিমণ ধানে প্রায় ১০০ থেকে ২০০ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। পুরোদমে কাটা ও মাড়াই শুরু হলে ধানের দাম আরো কমতে পারে এ আশঙ্কায় ব্যবসায়ীরা ধান কিনছে না। তারা হাটে গিয়ে বাজার দর ও আমদানি পর্যবেক্ষণ করছেন বলে কয়েকজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন। এদিকে কৃষকের হাতে নগদ টাকা না থাকায় তার চরম বিপাকে পড়েছেন। নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দাম বাড়ায় প্রান্তিক ও বর্গাচাষিদের দিন কাটছে অর্ধাহারে-অনাহারে। এদিকে ধানের দাম কমে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে চালের বাজারে।
ফরিদপুর উপজেলার ডেমরা গ্রামের কৃষক নান্নুু মিয়া নিজের জমিতে প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা মজুরি দিয়ে শ্রমিক খাটিয়ে বোরো ধান আবাদ করেন। উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে তিনি হিসাব করে দেখেন তার লাভ তো দুরের কথা, খরচই উঠছে না। শুধু তিনি নন, পাবনার হাজার হাজার কৃষকের অবস্থা একই রকম। কয়েক বছর ধরে কৃষি উপকরণের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি ও কৃষকের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় কৃষি অলাভজনক পেশায় পরিনত হয়েছে। এর বিরুপ প্রভাব পড়েছে গ্রামীন অর্থনীতিতে। প্রান্তিক ও বর্গাচাষিরা এনজিও’র এক ঋন থেকে আরেক ঋণের জালে আটকে পড়ছেন।
কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কৃষি উপকরণসহ শ্রমের দাম অনেক বেড়ে চলেছে, সে হারে উৎপাদিত কৃষি পণ্যের দাম বাড়ছে না। এর পেছনে তারা সরকারের অভ্যন্তরীণ বাজারনীতিকে দায়ী করেছেন। এ অঞ্চলের বেশির ভাগ কৃষকই দরিদ্র , প্রান্তিক ও বর্গাচাষি পর্যায়ের। তারা ঋণ করে ফসল উৎপাদন করেন। মওসুমি ফসল ওঠার সাথে সাথে বিক্রি করে দেনা শোধ করতে হয়। তারা একযোগে ফসল বিক্রির জন্য বাজারে আনতে বাধ্য হন। সরকারের সঠিক ক্রয়নীতি না থাকায় এ সময় বাজার নিয়ন্ত্রন করে এক শ্রেনীর ফড়িয়া ও দালাল। কৃষকের গোলাশুন্য হলে কৃষিজ পণ্যের দাম বাড়ে। আর এ দামের সুবিধা পায় মজুতদার ও মধ্যস্বত্বভোগীরা, বঞ্চিত হন কৃষক।
পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার ধুলাউড়ি গ্রামের কৃষক আজিজ মোল্লা বলেন, বোরোর ধানের দাম কম হওয়ায় কৃষকরা মহাজনের ঋণ শোধ করতে পারছেন না। এতে তারা ঋণে জালে আটকা পড়ছেন। কৃষক ধান হাটে নিয়ে পানির দামে বিক্রি করছেন। কৃষকের কাছে কোন বিকল্প না থাকায় তারা বাধ্য হয়েই আবার মাঠে নামছেন ফসল উৎপাদনের জন্য। সেলন্দা গ্রামের কৃষক আজাহার মিয়া বলেন, বাজারে ধানের কোন চাহিদা নেই। উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে তিনি হিসাব করে দেখেন তার লাভ তো দুরের কথা উৎপাদন খরচই উঠতে চায় না। কৃষকের হাতে যখন ধান থাকবে না তখন দাম বাড়বে। বাড়তি দামের সুফল কৃষকের কোন উপকারে আসবে না বলে তিনি জানান।
বেড়া সিঅ্যান্ডবি চতুরহাটে গতকাল মঙ্গলবার (৭মে) সকালে একাধিক কৃষকের সাথে কথা হয়। হরিরামপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত কৃষক হিসেবে পরিচিত আব্দুল মান্নান ১০ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমির সেচ তিন হাজার টাকা, হালচাষ-রোপণে কৃষাণ তিন হাজার টাকা, সার-বীজ-নিড়ানি-কীটনাশক দুই হাজার ৫০০ টাকা, কাটা মাড়াই চার হাজার টাকা এবং পরিবহন বাবদ ৫০০ টাকা খরচ হয়েছে। সব মিলিয়ে তার খরচ হয়েছে ১৩ হাজার টাকা। তিনি প্রতি বিঘা ধান পেয়েছেন ১৮ মন। যার বর্তমান বাজার মূল্য সাড়ে নয় হাজার থেকে সাড়ে ১০ হাজার টাকা। অথচ উৎপাদন খরচ হয়েছে ১৩ হাজার টাকা। প্রতি বিঘা জমিতে তার লোকসান হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার টাকা।
পাবনার কৃষকদের প্রধান ফসল বোরো ধানের দাম কমে যাওয়ায় তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার প্রভাব পড়ছে গ্রামীন অর্থনীতিতে। এ অঞ্চলের গ্রামীন অর্থনীতিতে বিরাজ করছে মন্দাভাব। ঋণের জালে আটকে যাচ্ছেন কৃষক। ব্যাংকঋণ সহজলভ্য না হওয়ায় বেশির ভাগ কৃষক চড়া সুদে দাদন নিয়ে বোরো ধানের আবাদ করেছিলেন। ধানের দাম কমে যাওয়ায় কৃষকরা ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারছেন না। ফলে প্রান্তিক ও বর্গাচাষিরা এনজিও’র এক ঋন থেকে আরেক ঋণের জালে আটকে পড়ছেন।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের (খামারবাড়ী) উপ-পরিচালক মোঃ আজাহার আলী জানান, আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় চলতি মওসুমে বোরো ধানের উৎপাদন ভাল হয়েছে। তবে দাম আরেকটু বেশি থাকলে কৃষকের জন্য ভাল হতো।