পাবনা-নাটোর ও সিরাজগঞ্জের খেজুর গুড়ের সেই ঐতিহ্য আর নেই হাট-বাজারগুলো এখন ভেজাল গুড়ে সয়লাব

0
504

শফিউল আযম ঃ
শীতকালে খেজুর গুড় ও পাটালির তৈরি পিঠা ও পায়েশের নাম শুনলেই জিহ্বায় পানি চলে আসে। এবারো শীত মওসুমে জমে উঠেছে খেজুরের গুড় ও পাটালি উৎপাদন। সেই সাথে বেড়েছে চাহিদা। যোগানও প্রচুর। তবে তা গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী প্রকৃত খেজুর গুড় নয়; চিনি ও আখের গুড় দিয়ে তৈরি হচ্ছে খেজুর গুড়। এসব গুড় তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে সোডা ও ফিটকিরিসহসহ বিপদজনক রাসায়নিক পদার্থ। এতে খেজুর গুড়ের মৌলিক স্বাদ গন্ধ হারিয়ে যাচ্ছে। এক শ্রেনীর অসাধু ব্যবসায়ী এ ধরণের ভেজাল গুড় ও পাটালি তৈরি করে দেদারছে হাট-বাজারে কেনা-বেচা করছে।
খেজুরের রস ছাড়া শীতকালের কথা ভাবাই যায় না। একসময় শীতকাল এলেই গ্রামের মানুষের সকালের নাস্তায় থাকতো মুড়ির সঙ্গে খেজুরের রস। গ্রামীন জীবনে উৎসবের আমেজ নিয়ে আসতো এই রস। কিন্তু নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে কাঁচা বা সরাসরি গাছ থেকে সংগ্রহ করা খেজুরের রস পান করা উঠেই গেছে প্রায়। তবে এই রস থেকে গুড় তৈরির চাহিদা কমেনি।
পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিফতর সূত্রে জানা যায়, এই তিন জেলায় প্রায় নয় লাখ ৭৫ হাজার খেজুর গাছ রয়েছে। পরিসংখ্যান মতে, প্রতিটি গাছ বছরের শীত মওসুমে ১৮০ লিটার রস দেয়। প্রতি ১০ লিটার খেজুর রসে এক কেজি গুড় হয়। সেই হিসেবে চার লাখ ৩৪ হাজার ৭৫০ মণ খাঁটি খেজুরের গুড় উৎপাদন হবে। এতে প্রতি কেজি গুড় উৎপাদক পর্যায়ে গড়ে ১০০ টাকা কেজি দরে বাজারে আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১৭৪ কোটি টাকা।
নাটোর জেলায় খেজুড়ের গুড় বেশি উৎপাদন হওয়ায় প্রতিটি উপজেলায় গড়ে উঠেছে আড়ত। নাটোরের সদর উপজেলার স্টেশন বাজার, বড়াইগ্রামের বনপাড়া বাজার, লালপুর বাজার, সিংড়ার, নলডাঙ্গা, বাগাতিপাড়া ও গুরুদাসপুরের চাঁচকৈর এলাকায় রয়েছে এসব আড়ত। গুড় তৈরির সাথে জড়িতরা শীতকাল শুরুর আগে থেকেই গাছ মালিকদের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে অথবা রস কিম্বা গুড়ের ভাগ দেয়ার চুক্তি করেন। তারপার শুরু হয় গুড় তৈরি। তারা এই পাতলা গুড় (লালিগুড়) এবং পাটাগুড় (বাটি সাইজ শক্ত গুড়) তৈরি করে বাজারে বিক্রি করেন। শীতে পিঠা, পায়েশ তৈরির অন্যতম উপাদান হিসেবে এই গুড়ের বিশেষ চাহিদা রয়েছে। তাই শীত মওসুমে ভালো আয় হয় এই এই পেশার মানুষের । জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্থানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নাটোরের তৈরি খেজুরের গুড়ের বিশেষ চাহিদা রয়েছে।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও নাটোর জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে এবং পাইকারি মোকামে প্রতিদিন শত শত মণ গুড় ও পাটালি বেচাকেনা হয়। মোকামগুলোতে প্রতিমাসে ২০ থেকে ২৫ কোটি টাকার ব্যবস্যা চলে। ব্যবসায়ীরা প্যাকেট ও টিনজাত পদ্ধতিেিত দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি করছে। বিদেশের বাজারে বাংলাদেশে তৈরি খেজুর গুড় ও পাটালি ব্যপক চাহিদা রয়েছে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, এক শ্রেনীর অসাধু ব্যবসায়ীরা বাড়তি মুনাফার আশায় তৈরি করছেন ভেজাল খেজুর গুড়। পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর নাটোরের গুরুদাসপুর, সিংড়া সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া. তাড়াশ, সলঙ্গা ও রায়গঞ্জে প্রায় ৩৫০টি গুড় উৎপাদনকারী কারখানায় ভেজাল খেজুরের গুড় তৈরি করা হচ্ছে। এসব কারখানায় প্রতিদিন শত শত মণ ভেজাল খেজুরের গুড় তৈরি করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। তারা বাজার থেকে নিন্মমানের ঝোলা ও নরম গুড় অল্প দামে কিনে তাতে চিনি, রং, হাইড্রোজ, সোডা, ফিটকারি, নানা রাসায়নিক পদার্থ ও ফ্লেভার মিশিয়ে কথিত খাঁটি খেজুরের গুড় ও পাটালি তৈরি করছে। সেই গুড় স্থানী হাট-বাজারসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হচ্ছে।
নাটোরের গুরুদাসপুর পৌর এলাকার চাঁচকৈর বাজারে গুড় তৈরির কারখানায় দেখা যায়, বিভিন্ন বাজার থেকে কিনে আনা নিন্নমানের ময়লাযুক্ত নোংরা মেঝেতে মেঝেতে ফেলে গুড়ো করছে শ্রমিকরা। পাশেই রয়েছে চিনির বস্তা। এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ভেজাল খেজুরের গুড় তৈরি করে দেশে বিভিন্ন অঞ্চলে তা বাজারজাত করা হচ্ছে। ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষন করতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় গুড়ের রং সাদা ও আকর্ষণীয় করার প্রতিযোগীতায় নেমেছে এসব অসাধু ব্যবসায়ী। প্রকৃত খেজুর গুড় চিনতে না পারে ক্রেতারা এই ভেজাল গুড় কিনে প্রতারিত হচ্ছেন।
সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার বড় গুড়ের মোকাম রানীরহাট, ভাদাস, তালম, নওগাঁ, গুল্টা হাটে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মানভেদে প্রতি কেজি খেজুড় গুড় খুচরা বাজারে ৮০ থেকে ৯০ টাকা ও ঝোলা গুড় ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। নওগাঁ হাটে গুড় বিক্রি করতে আসা গুড় উৎপাদনকারী আশরাফ আলী, আব্দুল খালেকসহ অনেকেই জানান, তারা প্রতিটি খেজুর গাছের জন্য মালিককে মওসুমভিত্তিক ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা দিয়ে থাকেন। প্রতি কেজি গুড় উৎপাদনে খরচ হয় জ্বালানি-মজুরীসহ প্রায় ৮০ টাকা। আর খাঁটি গুড় উৎপাদন করতে খরচ হয় গড়ে ১০০ টাকা। তাই উৎপাদন খরচ পুষিয়ে নিতে ২০ লিটার খেজুর রসে পাঁচ কেজি চিনি মেশান তারা। এতে উৎপাদন বেড়ে দ্বিগুন হয়। গুড় শক্ত ও এর রং ফর্সা করতে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ মেশাতে হয়। তারা জানান, চিনিমুক্ত গুড়ের রং হয় কালো। তাতে প্রকৃত স্বাদ-গন্ধ অটুট থাকে। এই গুড় প্রতি কেজি কমপক্ষে ১২০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়।
বড়াইগ্রামেন বনপাড়ার আড়তদার পীযূষ জানান, বনপাড়া বাজারে ১০টি আড়ত রয়েছে। সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার হাটে খেজুর গুড় কিনতে আসে সিরাজগঞ্জ, ফেনী, বগুড়া, রংপুর, পাবনা, টাংগাইল, ঢাকা, চট্রগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকার ব্যাপারী। তারা নিজেরাও গুড় কিনে দেশের বিভিন্ন জেলার ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। প্রতি সপ্তাহে বড়াইগ্রামের আড়ত থেকে অন্তত ৬০ হাজার কেজি গুড় দেশে বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ হয়। তবে সব খরচ বাদে তাদের কেজি প্রতি গড়ে দুই থেকে তিন টাকা লাভ থাকে বলে দাবি করেন পিযূষ।
ঢাকা থেকে আসা পাইকার আব্দুস ছালাম, শুকুর আলী, রমজান মিয়া ও বগুড়া শহর থেকে আসা শাহেদ আলী ব্যাপারী, আক্কাস ব্যাপারী জানান, খেজুর গুড়ের সেই ঐতিহ্য আর নেই। প্রান্তিক পর্যায়ের মৌসুমি গুড় উৎপাদনকারী ও মহাজন সবাই ভেজাল গুড় তৈরি করছেন। তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই ক্ষতিকর রাসায়নিক মিশিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছেন।
নাটোরের লালপুর উপজেলার সদর বাজারে অনেক গাছি ও সাধারন কৃষককে খেজুরের গুড় বিক্রি করতে দেখা যায়। উপজেলার কদিমচিলাম গ্রামের রতন জানান, তিনি ৫০টি গাছ চুক্তিভিত্তিক নিয়ে গুড় তৈরি করছেন। গত কার্তিক মাস থেকে তিনি গুড় তৈরি ও বিক্রি করছেন। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে সপ্তাহে তিনি ৩০ থেকে ৩৫ কেজি গুড় বিক্রি করছেন। বর্তমানে ৮০ টাকা কেজি দরে তিনি গুড় বিক্রি করছেন।
এ ব্যাপারে পাবনার বেড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (টিএইচএ) ডাঃ সরদার মিলন মাহমুদ জানান, খেজুর গুড়ে চিনি, হাইড্রোজ, সোডা, রং, ফিটকারিসহ রাসায়নিক পদার্থ মেশানোর কারণে কিডনি ড্যামেজ, খাদ্যনালিতে ক্যান্সার ও লিভারে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here