পাবনা-সিরাজগঞ্জের তাঁত কারখানাগুলো ঈদে কর্মমূখর হয়ে উঠেছে

0
507

শফিউল আযম ঃ
দীর্ঘ মন্দার পর রমজানের ঈদ সামনে রেখে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের তাঁত প্রধান এলাকাগুলো কর্মমূখর হয়ে উঠেছে। তাঁত মালিক ও শ্রমিকেরা ব্যস্ত সময় পাড় করছেন। দু’টি জেলায় তৈরি হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানের উন্নত আধুনিক রুচিশীল কাপড়। সিল্ক জামদানী, সূতি জামদানী, সূতি কাতান, চোষা, বেনারশী, মিষ্টি পরী শাড়ি, শেড শাড়ী ও লুঙ্গী তৈরি হচ্ছে তাঁত পল্ল¬ীগুলোতে। শাড়ীর উপরে বর্ণিল সুতা, ব¬াক ও চুমকির কাজ করা হচ্ছে। এছাড়া, কাপড়ের উপর প্রিন্ট এবং রঙ তুলির আঁচড়ে হাতে করা হচ্ছে নান্দনিক ও মনোমুগ্ধকর নানা নকশা। আর এই নান্দনিক মনোমুগ্ধকর নানা নকশার তৈরি কাপড়ের চাহিদা ও সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে ভারতের পশ্চিমবাংলায়।
পাবনার ঈশ্বরদী ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, চৌহালীতে তৈরি তাঁতবস্ত্র ইতোমধ্যে ভারতসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী কাপড় সরবরাহ দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তাঁত কারখানার মালিকরা। কাপড়ের উৎপাদন বাড়াতে দিন রাত কাজ করে চলেছেন তাঁত শ্রমিকরা। কারখানার মালিক ও শ্রমিকদের কোলাহলে সরব হয়ে উঠেছে শাহজাদপুর, উল¬াপাড়া, বেলকুচি, চৌহালী, সুজানগর ও ঈশ্বরদী উপজেলার তাঁত পল্লী। কারখানা মালিক ও শ্রমিকদের। বসে নেই নারীরাও। পুরুষের সঙ্গে পাল¬া দিয়ে নলীভরা, সুতাপারি করা, মাড়দেয়া ও রঙ-তুলিতে নকশা আঁকাসহ কাপড় বুননোর কাজেও সহযোগিতা করছে ওই এলাকার নারী শ্রমিকরা। বাজারে কাপড়ের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে দাম অনেক বেড়েছে। এই মূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসাবে রঙ-সুতাসহ তাঁত উপকরণের মূল্য বৃদ্ধিকেই দায়ী করছেন তাঁত ব্যবসায়ের সাথে জড়িত মালিক ও ব্যবসায়ীরা।
পাবনা তাঁতী সমবায় সমিতির সভাপতি শাহজাহান আলী আশরাফী জানান, দেশীয় এই তাঁত শিল্পকে তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে আন্তর্জাতিক মানের এবং সময় উপযোগী ডিজাইন নিয়ে আসায় এ শিল্প প্রাণ ফিওে পেয়েছে। তাঁতীরা এ শিল্পকে আর অলাভজনক পেশা হিসাবে দেখছেন না। মানন্ধাত্তার আমলের বুনোন শৈলী ও জ্যাকেট পাইড়ের শাড়ি বাদ দিয়ে ডিজাইনারদের পরামর্শ ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ শিল্পকে সমৃদ্ধ করছেন। ঈদ সামনে তাঁতের কাপড় বিক্রিতে এখন আর মন্দাভাব নেই। এ পেশার সাথে জড়িত সবাই এখন লাভের মুখ দেখছেন। সময় উপযোগী করে বুনোন শৈলী আর রঙের এর মাধুর্য দিয়ে তৈরি হচ্ছে এ অঞ্চলের তাঁতের কাপড়।
এ অঞ্চলের তাঁত পল¬¬ীগুলোতে উন্নতমানের সিল্ক জামদানী, সুতী কাতান, চোষা, সুতী জামদানী, বেনারশী, মিষ্টি পরী ও শেট শাড়ির পাশাপাশি মোটা শাড়ি, লুঙ্গী, থ্রী-পিচ ও থান কাপড় তৈরি হচ্ছে। এসব শাড়ি ও লুঙ্গী দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, ভারতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রফতানি হচ্ছে। ঢাকার বুটিক হাউজ কে-ক্রাফট তাদের পরিবেশকের মাধ্যমে কানাডা ও আমেরিকায় এবং নগরদোলা বুটিক হাউজ ইংল্যান্ডে বাজারজাত করছে। এছাড়া ঈদের বাজারে সোনার বাংলা টেক্্রটাইল, ডিসেন্ট, ইউনিক, ষ্ট্যান্ডার্ড, আমানত শাহ, রুহিতপুরী, স্মার্ট, অমর, পাকিজা, এটিএম, বোখারী, ফজর আলী, অনুসন্ধান, জেএম, স্কাই, চাচকিয়া, ওয়েষ্ট, রংধনুসহ ১২৫ ব্রান্ডের লুঙ্গি চাহিদা বেড়েছে। মান ভেদে প্রতি পিস লুঙ্গি ২৮০ টাকা থেকে এক হাজার ২০০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
ভারতী কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ভারতের পশ্চিমবাংলার উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিন ২৪ পরগনা, মেদিনীপুর, হুগলী, বর্ধমান, নদীয়, মূর্শীদাবাদ, মালদহ, জলপাইগুড়ি, পশ্চিমদিনাজপুর, উত্তরদিনাজপুর, দক্ষিণদিনাজপুর, কুচবিহার, হওড়া ও হুগলীসহ বিভিন্ন জেলার ছোট-বড় নামিদামী শপিংমল ও বিপণী বিতানগুলোতে বাংলাদেশে তৈরি বিভিন্ন ব্রান্ডের শাড়ী বিক্রি হয়। রমজানের ঈদ উপলক্ষে সেখানে বাংলাদেশি শাড়ীর বাজার জমে উঠতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, টাংগাইল, ঢাকা ও নারায়নগঞ্জ জেলার তাঁত কারখানাগুলোতে তৈরি সিল্ক জামদানী, সুতি জামদানী, কাতান, সুতি কাতান, রাজশাহী সিল্ক, বেনারশী, চোষা, শেড, স্বর্ণলতা শাড়ী ভারতে রফতানি হচ্ছে। আর এই নান্দনিক মনোমুগ্ধকর নানা নকশার তৈরি উন্নতমান, টেকসই, রুচিশীল শাড়ীর দাম কম হওযায় পশ্চিমবাংলার মহিলাদের বেশি পছন্দ বাংলাদেশি শাড়ী।
পশ্চিমবাংলার শিলিগুড়ির আমদানিকারক সেলিম খাঁন শাহজাদপুরহাটে এ প্রতিনিধিকে জানান, রমজানের ঈদের বাজার ধরা জন্য পশ্চিমবাংলার আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা তাদের প্রতিনিধির মাধ্যমে আতাইকুলা, শাহজাদপুরহাট, এনায়েতপুরহাট, করোটিয়াহাট, বাবুরহাট ও ডেমরাহাট থেকে শাড়ী কিনছেন। এছাড়া রাজশাহীর সিল্ক, গরদ, পাবনার ঈশ্বরদীর বেনারশি কাতান, সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া, বালসাবাড়ী, শাহাজাদপুরের দ¦াড়িয়াপুর, খঞ্জনদিয়ার, রামবাড়ি, এনায়েতপুর, বেতিল, বেলকুচি, খুকনী, উল্লাপাড়ার স্বর্ণলতা, চোষা ও শেড শাড়ী, টাংগাইল জেলার পাথরাইল, চন্ডি, নলসুধা, চিনাখোলা, দেওজান, নলুয়া, হিঙ্গানগর, এলাসিন, বাতুলি, বাজিদপুর, বল্লা, রামপুরের সুতি জামদানি, সিল্ক জামদানি ঢাকার মিরপুরের বেনারশি কাতান ও নারায়নগঞ্জের ডেমরার জামদানি তাঁত কারখানাগুলোতে গিয়ে পছন্দমতো প্রতি পিস শাড়ী এক হাজার ৫০০ থেকে ১৫-২০ হাজার টাকা দামে কিনে নিচ্ছেন।
তাঁতীদের নিজস্ব ডিজাইনে রেশম সুতা, খাদি, নয়েল, ডুপিয়ান ও এন্ডি সুতা ব্যবহার করে তাতে প্যালেস ও জরি মিশ্রত করে শাড়ী তৈরি করা হচ্ছে। তরুণ-তরুণীদের কথা মাথায় রেখে উন্নতমানের জামদানী নকশা, সেড ও থান কাপড় তৈরি করছে। এ দিয়ে পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ তৈরি হচ্ছে। জামদানী থ্রী-পিচ দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা এবং চেক থ্রী-পিচ ৯০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা দামে কিনছেন। পরে সেই কাপড় সড়ক পথে পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জেলায় শপিংমল, বিপণীবিতানগুলোতে সরবরাহ করা হচ্ছে।
শাহজাদপুরের পাইকারী কাপড় ব্যবসায়ী সোহেল মিয়া জানান, ভারতীয় ব্যবসায়ীরা শাহজাদপুর ও আতাইকুলা হাট থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২৫ কোটি টাকার কাপড় কিনে নিয়ে যাচ্ছে। এতে এ অঞ্চলের তাঁত শিল্প প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। ভারতের কলকাতার কাপড় ব্যবসায়ী গোপাল চন্দ্র সেন জানান, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের তৈরি কাপড় ভারতের কলকাতা শুভরাজ, গঙ্গা রামপুর ও পাটনা সহ বড় বড় শহরে বিক্রয় হচ্ছে। সে দেশের চেয়ে এদেশের কাপড়ের দাম তুলনামূলক কম, টেকশই এবং উন্নত মানের হওয়ায় তারা এখান থেকে কাপড় কিনছেন। তিনি জানান, ভারতের রফতানিকারকদের কাছে বাংলাদেশের লুঙ্গীর চাহিদা রয়েছে সব চেয়ে বেশী। তারা বাংলাদেশী লুঙ্গী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রফতানি করছে।
বিবিআনা, রঙ, কে-ক্রাফট ও নগরদোলা সহ দেশের শীর্ষ স্থানীয় বুটিক প্রতিষ্ঠানের কাপড় এখন সিরাজগঞ্জ-পাবনা অঞ্চলে তৈরি হয়। বুটিক হাউজগুলোর নিজস্ব ডিজাইনে রেশম সুতা, খাদি, নয়েল, ডুপিয়ান ও এন্ডি সুতা ব্যবহার করে তাতে প্যালেস ও জরি মিশ্রত করে কাপড় তৈরি করা হচ্ছে। বুটিক হাউজের ওড়না থান কাপড় ও এন্ডি থান কাপড়ের ফ্রেবিক্স তৈরি করা হচ্ছে তাঁত পল¬ীগুলোতে। এ দিয়ে নানা ধরণের পোশাক তৈরি করছে বুটিক হাউজগুলো। তরুণ-তরুণীদের কথা মাথায় রেখে তাঁতীরা উন্নতমানের জামদানী নকশা, সেড ও থান কাপড় তৈরি করছে। এ দিয়ে পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ আর ফতুয়া তৈরি হচ্ছে। জামদানী থ্রী-পিচ দুই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা এবং চেক থ্রী-পিচ ৮০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
এনায়েতপুরের খুকনীতে অবস্থিত ফিরোজ ইউভিং ফ্যাক্টরী লিমিটেডের সত্ত্বাধীকারি হাজী ফিরোজ হাসান অনিক জানান, এক দশকের বেশি সময় ধরে সুতা, রঙ ও তাঁত উপকরণের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি এবং ভারতীয় শাড়ির ও থ্রী-পিচের আগ্রাসনে তাঁত শিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ওই সময় অনেক তাঁতীই পুঁজি হারিয়ে কারখানা বন্ধ করে দেন। ফলে পাবনা-সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন। মানন্ধাত্তার আমলের বুনোন শৈলী বাদ দিয়ে ডিজাইনারদের পরামর্শ ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করায় এ শিল্পকে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। তাঁতিরা এ শিল্পকে আর অলাভজনক পেশা হিসেবে দেখছেন না। ফিরোজ ইউভিং ফ্যাক্টরী ম্যানেজার ইউসুফ আলী জানান, এবারের ঈদে বিশেষ আকর্ষন মিষ্টি পরী শাড়ি। উন্নতমানের সিল্কের তৈরী এ শাড়ির দুই দিকেই সদর। দাম হাতের নাগালের মধ্যে। দুই হাজার ৪০০ থেকে তিন হাজার টাকা। ইতোমধ্যে মিষ্টি পরী শাড়ির ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। কারখানায় উৎপাদিত শাড়ী আগাম বিক্রি হয়ে গেছে। এখন অর্ডারের শাড়ী তৈরীর কাজ চলছে।
পাইকারী বিক্রেতা আলাউদ্দিন জানান, দীর্ঘ মন্দার পর ঈদকে সামনে রেখে কাপড়ের বাজার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। তাঁতীদের পিছে পিছে ঘুরে চাহিদা অনুযায়ী কাপড় মিলছে না। ব্যবসায়ীরা অগ্রীম টাকা দিয়ে তাঁতীদের বাড়ি থেকে কাপড় কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। অনেক তাঁতীই তার কারখানার কাপড় আগাম বিক্রি করে দিয়েছেন। যদি কাপড় পাওয়া যায়- তবে তার দাম অনেক বেশি। মনিরামপুর গ্রামের তাঁতী শফিকুজ্জামান শফি বলেন, বাজারে কাপড়ের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু শ্রমিক সংকটের কারণে তারা কাপড়ের উৎপাদন বাড়াতে পারছেন না। দফায় দফায় সুতা, রং ও অন্যান্য উপকরনের দাম বাড়ার কারনেই কাপড়ের দাম বেড়েছে বলে তিনি জানান।
তাঁত শ্রমিক জামাল, সোলাইমান, রমজান আলী ও ইদ্রিস জানান, পরিশ্রম অনুযায়ী তারা মজুরি পাচ্ছেন না। তারা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে সপ্তাহে ১১০০ থেকে ১৩০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পান। বাজারে কাপড়ের দাম বাড়লেও তাদের মজুরি বাড়েনি। আগের তুলনায় কাপড় তৈরিতে সময় এবং পরিশ্রম বেশি হলেও মালিকপক্ষ নামমাত্র মজুরি বাড়িয়েছে। ঈদ সামনে রেখে পরিবারের চাহিদা মেটাতে বাড়তি রোজগারের আশায় তারা রাতদিন কাজ করছেন বলে জানান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here