পাবনা-সিরাজগঞ্জের দেড় লাখ গোখামারি ব্যাপক লোকসানে

0
344

শফিউল আযম, বেড়া (পাবনা) সংবাদদাতা ঃ
মরণঘাতি করোনাভাইরাসের কারণে তরল দুধের চাহিদা কমে যাওয়ায় বাঘাবাড়ী মিল্কভিটাসহ প্রায় ২০টি বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারি প্রতিষ্ঠানগুলো দুধ সংগ্রহের পরিমান কমিয়ে দিয়েছে। এতে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের প্রায় দেড় লাখ গো-খামারি ব্যাপক লোকসানে পড়েছেন। অনেক খামারি তাদের উৎপদিত দুধ রিক্সাভ্যানে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ফেরি করে ২০ থেকে ২৫ টাকা লিটার দরে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এছাড়া ননফ্যাট দুধ প্রতি লিটার ৫ থেকে ৭ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এদিকে উৎপাদিত দুধের দাম কম, গোখাদ্যের দাম বৃদ্ধি, অব্যাহত লোকসানসহ নানা কারণে এ অঞ্চলের অনেক গো-খামার বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৭৩ সালে দিকে পাবনা জেলার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর এবং সিরাজগঞ্জ জেলার শাহাজাদপুর ও উল্ল¬াপাড়া উপজেলা নিয়ে দেশের সর্ববৃহৎ দুগ্ধ অঞ্চল গড়ে উঠেছে। পাবনা-সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে প্রায় ৮০ হাজারের বেশি গো-খামার রয়েছে। এ ছাড়া গ্রামগুলোর প্রায় প্রতিটি বাড়ীতে গরু পালন করে দুধ উৎপাদন করা হয়। এ অঞ্চলে প্রতিদিন ১৫ থেকে সাড়ে ১৬ লাখ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। এরমধ্যে দেড় লাখ লিটার বাঘাবাড়ী মিল্কভিটা, আফতাব, আকিজ, ব্রাকসহ বিভিন্ন বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান চার লাখ ৫০ হাজার লিটার এবং প্রাণ এক লাখ লিটার দুধ ক্রয় করে সারা দেশে বাজারজাত করে আসছে। এ সব প্রতিষ্ঠানের দুধ সংগ্রহের পরিমাণ প্রতিদিন প্রায় ৭ থেকে ৮ লাখ লিটার। এছাড়া ঘোষেরা ৬০ থেকে ৭০ হাজার লিটার দুধ ক্রয় করে থাকে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অবশিষ্ট দুধ প্রক্রিয়াজাত করে বগুড়া, রংপুর, নাটোর, নওগাঁসহ বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করে থাকেন। সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দুধ ক্রয় কমিয়ে দিয়েছে। মিষ্ঠি ও চায়ের দোকান বন্ধ থাকায় তারা দুধ কিনছে না। ফলে উৎপাদিত দুধ নিয়ে খামারিরা বিপাকে পড়েছেন।
চরাচিথুলিয়া প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির কয়েকজন সদস্য সোহেল রানা, ইউসুফ আলী, রওশন আলী, আব্দুল আলীম জানিয়েছেন, খামারিরা সরকারি বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী পত্রিষ্ঠানসহ স্থানীয় হাট-বাজারে দুধ বিক্রি করতে না পেরে অনেকেই রিক্সাভ্যানে দুধ নিয়ে গ্রামে গ্রামে ফেরি করে ২০ থেকে ২৫ টাকা লিটার দরে বিক্রি করছেন। এতে তাদের দুধ উৎপাদন খরচই উঠছে না। এদিকে হঠাৎ করেই গো-খাদ্যের দাম বস্তা প্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা করে বৃদ্ধি পাওয়ায় খামারীরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। বিত্তশালী খামারিরা দুধের দাম কমে যাওয়ায় দুধ থেকে শতভাগ ননী তুলে ডীপফ্রিজে সংরক্ষণ করছেন। আবার কোন কোন খামারি দুধ থেকে ননী তুলে ঘি তৈরি করে মজুত করে রাখছেন। তবে যারা এই ভ্যাট তুলতে পারছেন না ব্যাপক লোকসানে পড়েছেন। তারা ভ্যানে করে গ্রামে গ্রামে ফেরি করে ২০-২৫ টাকা লিটার দরে দুধ বিক্রি করছেন। এতে তাদের গো-খাদ্যের দামই উঠছেনা।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার পোঁতাজিয়া প্রাথমিক দুগ্ধ সমবায় সমিতির সভাপতি ওয়াজেদ আলী জানিয়েছেন, দুধ থেকে ননী বা ফ্যাট বের করে নেয়ার পর ননফ্যাট দুধ বিক্রি হচ্ছে ৫ থেকে ৭ টাকা লিটার দরে। অবিশ্বাস্য হলেও ঘটনাটি সত্য। বাজারে ক্রেতা নেই। বাজারে ক্রেতা নেই, তাই খামারিরা কিছুটা লোকসান ঠেকাতে দুধ থেকে মেশিনের সাহায্যে শতভাগ ফ্যাট তুলে নিচ্ছে। এরপর সেই ননফ্যাট দুধ ৫ থেকে ৭ টাকা লিটার দরে বিক্রি করছে। এতে অল্প আয়ের মানুষ সহজেই দুধ কিনে খেতে পারছেন। ফ্যাট তুলে নিলেও দুধের গুনগতমান ঠিক থাকে। স্বাদের দিক দিয়ে একটু কম হয়। এই ননফ্যাট দুধ দিয়ে দই, মিষ্টি, পায়েশ, পিঠা সব কিছু তৈরি করা যায়। এটা স্বাস্থ্যের জন্য খুব ভাল।
তবে পোঁতাজিয়া প্রাথমিক দুগ্ধ সমবায় সমিতির সভাপতি ওয়াজেদ আলীর বক্তব্যের সাথে ভিন্নমত পোষণ করেছেন, সাঁথিয়া উপজেলার সরিষা গ্রামের অভিজ্ঞ ঘি ও ছানা প্রস্তÍতকারক সাধন কুমার ঘোষ। তিনি বলেছেন, আমারা ঘি তৈরির জন্য দুধ থেকে শতভাগ ফ্যাট তুলে নেয়ার অবিকল দুধের মতো দেখতে সাদা পানি ফেলে দেই। শতভাগ ফ্যাট তুলে নেয়ার পর এতে কোন পুষ্টি উপাদান থাকে না। ফলে এই ননফ্যাট দুধ পান করে মানুষের কোন উপকার হয় না। এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে ননফ্যাট দুধ বিক্রি করে তাদের সাথে প্রতারনা করছে।
খামারিরা জানিয়েছেন, দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে অফিস আদালত বন্ধ রয়েছে। ফলে মানুষজন ঢাকাসহ বড় বড় শহর ছেড়ে গ্রামে পাড়ি জমিয়েছে। ফলে শহরগুলোতে দুধের চাহিদা কমে গেছে। এছাড়া পাবনা-সিরাজগঞ্জ এলাকায় ছানা তৈরির কারখানা ও মিষ্টির দোকান বন্ধ থাকায় এসব কারখানা দুধ কিনছে না। এ এলাকায় শতাধিক ছানা তৈরির কারখানায় প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ হাজার লিটার দুধের প্রয়োজন হোত। এ অঞ্চলের চায়ের ও মিষ্টি তৈরির কয়েক হাজার দোকান বন্ধ রয়েছে। ফলে দুধের চাহিদা নেই বললেই চলে।
খামারিদের অভিযোগ, দুধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই হল খামারি ও কৃষকদের দুধ বিক্রি করার প্রধান ভরসা। কিন্তু বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান দুধ নেয়া কমিয়ে দিয়েছে। প্রাণ ডেইরি গুঁড়ো দুধ তৈরির জন্য এক লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ অব্যাহত রেখেছে। মিল্কভিটা প্রতিদিন বিকেলে মাত্র ৪৫ হাজার লিটার দুধ নিয়ে গুড়ো দুধ তৈরী করছে। অবশিষ্ঠ ৭ লাখ লিটার দুধ নিয়ে কৃষকেরা বিপাকে পড়েছেন। কৃষকদের দাবি, প্রতি লিটার দুধের উৎপাদন খরচ পড়ছে ৪২ টাকা। কিন্তু দুধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি লিটার দুধের দাম দিচ্ছে ৩৬ থেকে ৩৮ টাকা। এ ছাড়া তালিকাভূক্ত খামারিরা ছাড়া অন্য কেউ দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠাণগুলো দুধ বিক্রি করতে পারে না। চলমান এ অবস্থায় অধিকাংশ কৃষক ও খামারিকে স্থানীয় বাজার গুলোতে ও ভ্যানে করে গ্রামে গ্রামে গিয়ে ফেরি করে ২০ থেকে ২৫টাকা লিটার দরে দুধ বিক্রি করতে হচ্ছে।
সাঁথিয়া উপজেলার নাগডেমরা গ্রামের খামারি আব্দুস সালাম জানিয়েছেন, আমার খামারে দৈনিক ১০০ লিটার দুধ উৎপাদন হয়। কয়েকদিন আগেও একটি প্রতিষ্ঠান আমার কাছ থেকে দুধ নিয়ে ঢাকায় পাঠাতো। অথচ গত নয়দিন ধরে তারা দুধ নিচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে ঘোষের কাছে ৩৫টাকা লিটার দরে বাঁকীতে দুধ বিক্রি করছি।
সাঁথিয়া উপজেলার আমাইকোলা গ্রামের দুধ সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান সেফ মিল্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ শেখ বলেন, ১২ দিন আগে প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার লিটার দুধ ঢাকায় পাঠাতাম। অথচ এখন ৫০০ লিটারের বেশি পাঠাতে পারছি না। যে সব খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করতাম তাঁরা আমাদের মতো প্রতিষ্ঠানে দুধ দিতে না পেরে খোলা বাজারে পানির দরে দুধ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে।
পাবনার ফরিদপুর উপজেলার ডেমরা ইউনিয়নের কালিয়ানি গ্রামের খামারী বেলায়েত হোসেন জানান, তার এলাকায় দুধ ২৫ থেকে ৩০ টাকা লিটার দরে বিক্রি হচ্ছে। এর উপর করোনাভাইরাসের প্রভাবে হঠাৎ করেই বাজারে গোখাদ্যের দাম বস্তা প্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়ে গেছে। কয়েকদিন আগে ৪৫ কেজি ওজনের এক বস্তা ভুসির দাম ছিল এক হাজার ২২০ টাকা। এখন তা বেড়েয় বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৫০০ টাকা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৩০০ টাকা মণের খরের দাম বেড়ে হয়েছে ৪৫০ টাকা।
সরকারী দুগ্ধ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকারী সমবায়ী প্রতিষ্ঠান বাঘাবাড়ী মিল্কভিটার আওতাধীন শাহজাদপুর উপজেলার পোতাজিয়া দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির সভাপতি ওয়াজ আলী জানান, মিল্কভিটা বন্ধ থাকায় তাদের সমিতিভুক্ত কৃষকেরা উৎপাদিত দুধ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। ক্রেতার অভাবে তারা পানির দামে দুধ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। এতে লোকসানের মুখে পড়েছেন পাবনা-সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে গো-খামারি ও কৃষকরা।
ভাঙ্গুড়াদুগ্ধ উৎপাদনকারী প্রাথমিক সমবায় সমিতির সভাপতি ফজলুর রহমান জানিয়েছেন, পাবনার ভাঙ্গুড়া ও চাটমোহর উপজেলার কৃষকরা ৩০ থেকে ৩৫ টাকা দরে দুধ বিক্রি করছে। আবার কিছু কিছু এলাকায় ২৫ টাকা দরে দুধ বিক্রি করতে দেখা গেছে। তিনি বলেছেন, বিকাশমান দুগ্ধ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা স্বার্থে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। ক্ষতিগ্রস্থ খামারি ও চাষিদের আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। তাছাড়া এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। অব্যাহত লোকসানে অনেক খামার বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
সরকারী দুগ্ধ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকারী সমবায়ী প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটা পরিচালনা পরিষদের পরিচালক আব্দুস সামাদ ফকির বলেছেন, বাঘাবাড়ি মিল্কভিটা কারখানা দুধ কেনা বন্ধ থাকায় শিল্কশেড এরিয়ার খামারি ও চাষিরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছিলেন। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এখন প্রতিদিন বিকেলে ৪৫ হাজার লিটার দুধ নেয়া হচ্ছে। এতে খামারিরা কিছুটা হলেও উপকৃত হচ্ছেন।
বাঘাবাড়ি মিল্কভিটা কারখানার ডিজিএম ডা. ইদ্রিস আলী জানিয়েছেন, করোনার প্রভাবে সরকারী নির্দেশে ফ্যাক্টরী বন্ধ ছিল। আবার সরকারি নির্দেশে এক বেলা খোলা রাখা হয়েছে। সরকার আবার নির্দেশ দিলে ফ্যাক্টরী পুরোদমে চালু করা হবে। তিনি আরো বলেছেন, করোনার প্রভাবে বাজারে দুধের চাহিদা কমে গেছে। এদিকে ৯০০ মেট্রিকটন উৎপাদিত গুড়ো দুধ অবিক্রিত অবস্থায় গুদামে মজুদ রয়েছে। তারপরেও কৃষকদের কথা ভেবে কারখানা এক বেলা চালু রাখা হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here