শফিউল আযম, বেড়া (পাবনা) সংবাদদাতা:পাবনা-সিরাজগঞ্জের পদ্মা, যমুনা ও হুড়াসাগর নদীতে রাতে অবাধে চলছে মা ইলিশ শিকার। মৎস্যসম্পদ রক্ষা এবং ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে সরকার প্রজনন মওসুমে ইলিশ শিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ৩টি নদীর প্রায় ১১৬ কিলোমিটার এলাকাব্যাপী চলছে মা ইলিশ শিকার। নদী পাড়ের কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধির কারণে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানেও বন্ধ হচ্ছে না ইলিশ শিকার। এই মাছ বেচা-কেনার জন্য প্রায় ১৫-২০টি পয়েন্টে রাতে বসছে ভ্রাম্যমান বাজার। এসব বাজারে রাত ১০টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত চলছে ইলিশ বেচাকেনা।
ইলিশের প্রজনন মওসুমে সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সিরাজগঞ্জের যমুনা সেতুর ভাটি থেকে পাবনার বেড়ার ঢালারচরের বারকোদালিয়া পর্যন্ত যমুনা নদীর ৬০ কিলোমিটার, বারোকোদালিয়া থেকে পাবনা ঈশ্বরদী পর্যন্ত পদ্মায় ৫০ কিলোমিটার এবং মোহনগঞ্জ থেকে চয়ড়া পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার এলাকায় অবাধে চলছে মা ইলিশ শিকার। ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে জেলেরা মা ইলিশ শিকার করছে। তাদের জালে ডিমওয়ালা রুপালী ইলিশের সাথে ঝাঁকে ঝাঁকে জাটকা ধরা পড়ছে। প্রতিটি জালে মাত্র এক ঘন্টার ব্যবধানে ধরা পড়ছে প্রায় ১৫ থেকে ২০ কেজি মা ইলিশ। এসব ইলিশ আকার ভেদে ১৫০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে বড় আকারের ইলিশ প্রতি কেজি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। একটু কম দামে ইলিশ মাছ কেনার জন্য নিন্ম আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ হুমড়ী খেয়ে পড়ছে। স্থানীয় মাছের আরতদার ও জেলেরা অর্ডার অনুয়ায়ী মাছ ক্রেতার বাড়ীতে পৌছে দিচ্ছে বলে অনেকেই জানিয়েছেন।
সরেজমিন ও বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ঢালারচর, কাজীরহাট, নটাখোলা, রাকশা, হরিরামপুর, নাকালিয়া, পেঁচাকোলা, মোহনগঞ্জ, বৃশালিখা, অধিননগর, নাজিরগঞ্জ, চরনাগদাহ, বোয়ালকান্দি, দত্তকান্দি, দক্ষিন খাষকাউলিয়া, বিনানুই বাজার, আজিমুদ্দির মোড়, খগেন ঘাট, চরছলিমাবাদসহ সুজানগর উপজেলার নদী পাড়ের প্রায় ১৫-২০টি পয়েন্টে রাতে ইলিশ বেচাকেনার ভ্রাম্যমান বাজার বসছে। এসব বাজারে বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকাররা আসছে। তারা কম দামে ডিমওয়ালা মা ইলিশ মাছ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এলাকার অনেকেই ইলিশ কিনে শুধু নিজের ফ্রিজই ভরছেন না, সেই সাথে আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে পাঠাচ্ছেন।
প্রশাসনের চোখ ফাঁকী দিয়ে জেলেরা রাতে নদীতে ইলিশ ধরছে। স্থানীয় প্রশাসন প্রতিদিন ঝটিকা অভিযান চালিয়ে আটক জেলেদের বিভিন্ন মেয়াদে জেল জরিমানা ও কারেন্ট জাল পুড়িয়ে ধংস করছে। তাতেও থামছে না মা ইলিশ শিকার। কারণ অভিযানের খবর আগে ভাগেই জেলেদের কাছে পৌছে দেয়া হচ্ছে। প্রশাসনের অব্যাহত অভিযানের মুখে জেলেরা দিনে পদ্মা, যমুনা ও হড়াসাগর নদীতে মাছ শিকারে নামছে না। প্রশাসন রাতে অভিযান পরিচালনা না করায় তারা রাতে ইলিশ মাছ শিকার করছে। এ জন্য স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধি এবং আইনশৃক্সখলা বাহিনীর সদস্যদের নৌকা প্রতি নির্ধারিত হারে উৎকোচ দিতে হয়। জেলেরা বলেছেন, নিষেধাজ্ঞার এই সময়ে সরকারিভাবে তাদের যে সহায়তা পাওয়ার কথা ছিল, তা তারা পাননি। তাই বাধ্য হয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে তারা নদীতে মাছ ধরছেন।
সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার বোয়ালকান্দি চরে গিয়ে দেখা যায়, যমুনা নদীতে বেশ কিছু নৌকা মাছ শিকার করছে। ছোট ছোট ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ৩ থেকে ৪ জন করে জেলে মাছ ধরায় ব্যস্ত আছে। কেউ জাল ফেলছে, কেউ তুলছে আবার কেউবা নৌকা নিয়ন্ত্রন করছেন। চৌহালীর কয়েকজন জেলে জানান, তারা নিবিঘ্নে ইলিশ মাছ ধরার জন্য নৌকা প্রতি তিন হাজার টাকা হিসেবে একজন জনপ্রতিনিধিকে দেড় লাখ টাকা দিয়েছেন। থানা পুলিশ ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব ওই জনপ্রতিনিধি নিয়েছে বলে স্থানীয় জেলেরা জানিয়েছে।
বেড়ার মোহনগঞ্জের উজানে শাহাজাদপুর উপজেলার বিনোটিয়া অংশে বেশ কিছু ইঞ্জিন চালিত নৌকা নিয়ে জেলেদের ইলিশ শিকার করতে দেখা যায়। কিছু সময় পর সেখানে প্রায় ১৫ কেজি মাছ শিকার করে ফিরে আসা জেলে নিরু হলদার বলেন, পেটে দিলে পিঠে সয়। নিষেধাজ্ঞা দেবেন অথচ খাবার দেবেন না, তাহলে আমরা না খেয়ে মরবো। অপর জেলে ভিকু হলদার বলেন, ‘শুনছিলাম মৎস্য অফিস এই নিষেধাজ্ঞার সময় আমাগের চাল দেবে’। চালতো দেয়া দুরের কথা, একবারের জন্য জিজ্ঞাসা করে নাই আমরা কেমন আছি। বরং যারা তাগের ফাঁকি দিয়ে নদীতে নামতাছে তাগরে ধইরা নিয়ে জেলে ঢুকাইয়া দিতাছে। বিনোটিয়া গ্রামের অহেদ আলী বলেন, এই এলাকায় কোন অভিযান পরিচালিত না হওয়ায় জেলেরা নিবিঘ্নে ডিম ওয়ালা ইলিশ মাছ শিকার করছে।
জেলে পরিমল হলদার বলেন, নদীর পাড়ে বসবাস করা বেশির ভাগ জেলেই দিন আনে দিন খাওয়া পরিবারের সদস্য। একদিন নদীতে মাছ না ধরলে তাদের পরিবারের সদস্যদের অনাহার আর অর্ধাহারে দিন কাটাতে হয়। তাই প্রশাসন নিষেধাজ্ঞা জারির সাথে সাথে যদি চাল বিতরন করত তাহলে জেলেরা নদীতে নামতে আর সাহস পেত না। এ কার্যক্রমটা আরো বেগবান হতো। গত বছরে তাদের কোন চাল দেয়া হয়নি। তাই জরুরি ভিত্তিতে তিনি তাদের মাঝে চাল বিতরনের দাবি জানান। এদিকে মা ইলিশ রক্ষায় প্রতিদিনই জেলা-উপজেলা মৎস্য বিভাগ, জেলা-উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় পদ্ম্ ও যমুনা নদীতে অভিযান পরিচালনা করে আটক করা হচ্ছে জেলেদের। জব্দ করা হচ্ছে কারেন্ট জাল ও মাছ। ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে আটক জেলেদের করা হচ্ছে জরিমানা এবং দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড। পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে জাল।
একাধিক জেলে বলেন, যে সময় নদীতে মাছ বেশি পাওয়া যায় সে সময় মাছ ধরতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। এ সময় মাছ ধরতে নদীতে নামলেই জাল নৌকাসহ তাদের ধরে নিয়ে জেল জরিমানা করা হয়। কিন্তু মাছ ধরেই তাদের সংসার চলে। মাছ ধরা বন্ধ থাকলে তাদেও সংসার চলবে কিভাবে ? এ জন্য বাধ্য হয়েই জেল-জরিমানার ভয় না করে মাছ ধরতে নদীতে নামছেন তারা। তাছাড়া কোন সাহায়্য-সহযোগিতা পাচ্ছেন না। এ সময় তারা সাহায্য-সহযোগিতা পেলে নদীতে মাছ ধরা বন্ধ রাখতেন।
পাবনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আব্দুর রউফ অভিযানে ব্যস্ত থাকার কারণে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। তবে জেলা মৎস্য অফিসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছু দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, জেলা-উপজেলা মৎস্য বিভাগ পদ্মা ও যমুনা নদীকে মাছ ধরার নৌকা মুক্ত রাখতে দিন-রাত পরিশ্রম করছে। এতে সহযোগীতা করছেন জেলা, উপজেলা ও পুলিশ প্রশাসন। ভ্রাম্যমান আদালত প্রায় প্রতিদিন অভিযান চালিয়ে জেলেদের বিভিন্ন মেয়াদে জেল-জরিমানা করছে। সেই সাথে কারেন্ট জাল উদ্ধার করে তা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করা হচ্ছে। অভিযান চলাকালে জেলেদের খাদ্য সহায়তা দেয়া প্রয়োজন থাকলেও তারা এখনো সহায়তা পাচ্ছেন না। জেলেদের ভিজিএফ সহায়তা দেয়ার জন্য মৎস্য বিভাগ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে তিনি জানিয়েছেন।