শফিউল আযম, বেড়া (পাবনা) সংবাদদাতা ঃ
পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে বোরো ধান কাটা মাড়াই চলছে পুরোদমে। ধানই কৃষকের জীবন; অথচ সেই ধানই যেন হয়ে গেছে কৃষকের মরণ। ন্যায্যদাম না পাওয়ায় উৎপাদিত ধান নিয়ে মরণ দশায় পড়েছেন কৃষকেরা। প্রতিমণ ধান উৎপাদনে এলাকাভেদে খরচ পড়েছে ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা। হাট-বাজারে প্রতিমণ বিআর-২৮ ধান ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা, মিনিকেট ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গত বছর মওসুমের শুরুতে প্রকারভেদে প্রতিমণ ধান বিক্রি হয়েছে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায়।
চলতি মওসুমে বোরো ধান আবাদ করে প্রতিবিঘা জমিতে কৃষকের লোকসান হচ্ছে প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। আগাম দাদন নিয়ে ধান আবাদ করায় টাকা পরিশোধের তাগাদায় লোকসান দিয়েই ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক। তাই বাম্পার ফলনে হাসি নেই কৃষকের মুখে। অপরদিকে কৃষি শ্রমিক সঙ্কটে মাঠের ধান কেটে ঘরে তোলা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। একজন ক্ষেত মজুর ৮ ঘন্টা কাজের বিনিময়ে পাচ্ছেন ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। অথচ প্রকারভেদে প্রতিমণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা।
কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলায় এবার প্রায় এক লাখ ৫৫ হাজার হেক্টর (প্রায় ১১ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ বিঘা) জমিতে বোরোর ধানের আবাদ হয়েছে। হেক্টর প্রতি ধানের ফলন চার দশমিক পাঁচ ও চালের ফলন দুই দশমিক সাত মেট্রিক টন ধরা হয়েছে। সে হিসেবে এবছর ছয় লাখ ৯৭ হাজার ৫০০ টন ধান ও চার লাখ ১৮ হাজা ৫০০ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। আবহাওয়া অনুকুল থাকায় বোরোর ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। স্থানীয় হাট-বাজারে প্রচুর ধান আমদানি হচ্ছে। ধানের ক্রেতা, চাহিদা ও দাম কম। বাজারদর নিয়ন্ত্রন করছে ফড়িয়া ও দালালেরা। এ অঞ্চলের প্রায় সাত লাখ কৃষক পরিবার বোরো আবাদের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত বলে কৃষি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
পাবনা-সিরাজগঞ্জের কৃষকদের বোরো ধানের দামই ছিল ভরসা। উৎপাদিত বোরো ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার প্রভাব পড়ছে গ্রামীন অর্থনীতিতে। এ অঞ্চলের গ্রামীন অর্থনীতিতে বিরাজ করছে মন্দাভাব। ঋণের জালে আটকে যাচ্ছেন কৃষক। বেশির ভাগ কৃষক চড়া সুদে দাদন নিয়ে বোরো ধানের আবাদ করেছিলেন। বোরো ধান আবাদ করে বিঘা প্রতি চার হাজার টাকা লোকসান দিতে হচ্ছে। সেই হিসেবে চলতি বোরো মওসুমে এ অঞ্চলের কৃষকদের প্রায় ৪৫৬ কোটি টাকা লোকসান হতে পারে বলে কৃষি সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন। এদিকে কৃষি শ্রমিক সঙ্কটে মাঠের ধান কেটে ঘরে তোলা যাচ্ছে না। কৃষক পরিবারের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া ছেলেরা ধান কাটতে মাঠে নেমে পড়েছে।
বাঘাবাড়ি থেকে ফরিদপুর যেতে সড়কের পাশে “ক্ষেতে বাতাসে দুলছে ধানের যৌবন/ঘরে ঘরে পুরছে যুবতীর পিতা-মাতার মন” অচেনা এই গান শুনে তাকাতেই চোখে পড়ল জমির ধান কাটতে কাটতে আনমনে গান গাইছেন ১০ জন ক্ষেতমজুর। এ গান আঞ্চলিক কিনা জানতে চাইলে সিএনজি চালক আব্দুল খালেক জানালেন স্যার বুঝলেন না, এটা ক্ষেতমজুরদের গান। কৃষক ১৪ হাজার টাকা খরচ করে ধান আবাদ করে বিক্রি করছে ১০ হাজার টাকা। ফলন ভালো কিন্তু ধানের দরপতনে মেয়ের বিয়ে দিতে পারছেন না, দাদনের টাকা পরিশোধ করতেই সব শেষ। অথচ ঘরে ঘরে বিবাহযোগ্য মেয়ে। কৃষকের ধানই সব। অথচ সেই ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় সর্বনাশ। ক্ষেতে ধান রেখেই গ্রামের কৃষকেরা অনেক স্বপ্ন বোনেন। ধান বিক্রি করে কেউ মেয়ের বিয়ে দেবেন, কেউ বছরের জামা-কাপড়, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার যোগান দেবেন, ধার-দেনা দেবেন, স্ত্রীর শখ মেটাবেন।
জানা যায়, কেউ ধার-দেনা করে, কেউ দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে আগাম টাকা নিয়ে জমিতে ধান বুনেছিলেন। ফলন হয়েছে বাম্পার। কিন্তু বাজারে ধানের দরপতনে সব স্বপ্নই শেষ। এক মন ধান উৎপাদনে খরচ হয়েছে জমি ভেদে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। অথচ এলাকাভেদে বিআর-২৮ ধান ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা, মিনিকেট ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা দরে প্রতিমণ ধান বিক্রি হচ্ছে। গত বছর মওসুমের শুরুতে প্রকারভেদে প্রতিমণ ধান বিক্রি হয়েছে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায়। বর্তমানে একজন ক্ষেত মজুরের প্রতিদিনের মজুরি ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা। কৃষকের কপাল পুরছে অথচ ক্ষেতমজুরেরা আনন্দে গান গাইছে। সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী থেকে পাবনার ফরিদপুর যাওয়ার পথে চরাচিথুলিয়া, সেলন্দা, পাথালিয়াহাট, নাগডেমরা, বড়ডেমরা, কালিয়ানি, মাজাট গ্রামে চোখে পড়ে এ দৃশ্য।
চোখ যেদিকে যায় দেখলে মনে হবে মাঠের পর মাঠজুড়ে কেউ সোনালি গালিচা বিছিয়ে রেখেছে। বাতাসে পাঁকা ধানের শিষ দোলা খাচ্ছে। সোনা রাঙা ধানের ওপর রোদ পড়ে চিকচিক করছে। সোনালি ফসলের সমারোহ; প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আবহাওয়া ভালো হওয়ায় ফলন হয়েছে ভালো। কৃষাণ-কৃষাণিদের ঘরে ঘরে ধান কাটা মাড়াই চলছে। তারা ধান বিক্রি করে মেয়ে বিয়ে দেয়ার স্বপ্ন দেখছেন। কিন্তু ধানের যে দাম তাতে স্বপ্ন পুরণতো দুরের কথা জমি বিক্রি করে দাদনের টাকা শোধ করতে হবে।
বাঘাবাড়ী থেকে সিএনজিতে (কাটাএ্যাম্বুলেন্স) ফরিদপুর যাওয়ার সময় সড়কের পাশে পাথালিয়াহাট গ্রামে হঠাৎ চোখে পড়ল গৃহস্থের উঠানে কয়েকজন মেয়ে বাতাসে ধান (বাতাসে চিটা পাতা থেকে ধান আলাদা করা) উড়াচ্ছে। দু’জন পুরুষ হাঁকডাক করছেন। কয়েক গজ এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল কয়েকজন পুরুষ বসে গল্প করছেন। ধানের দাম না থাকায় নিজেদের দুর্দশার কথা একে অন্যকে শোনাচ্ছেন। একটু দুরে এক কৃষক মাথায় হাত দিয়ে মুখ নিচু করে কি যেন করছেন। কাছে যেতেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। খালি গায়ের উসকো খুসকো লোকটাকে দেখেই সিএনজি চালক বললেন, স্যার দেখেন কৃষকের হাল। ধান চাষ করে এ অবস্থা হয়েছে। কফিল নামের ওই কৃষক বললেন, আমার কপাল পুরছে বাবা। কৃষকের দিকে দেখার কেউ নাই। ধানের দাম এত কম ক্যান হলো বুঝতে পারি নাই। বুঝলেন দাদনে টাকা নিয়া ধান আবাদ কইরা এখন ফতুর ওতে না হয়। মেয়ের বিয়া ঠিক ওইছে। এখন কি করমু বুঝবার পারছি না।
বাঘাবাড়ী দক্ষিণপাড়ের চৌরাস্তা থেকে চরাচিথুলিয়া, সেলন্দা, পাথালিয়াহাট, বড়ডেমরা, বনওয়ারিনগর হয়ে ফরিদপুরে নামতে হলো। সিএনজি ভাঙ্গুড়া হয়ে চাটমোহর চলে যাবে। পথে কেউ নামছেন আবার কেউ উঠছেন। বিভিন্ন জনের সাথে ধানের ফলন ও দাম নিয়ে কথা হলো। সবার এক কথা ধানের দাম কৃষকের সর্বনাশ করেছে। ফলন ভালো হওয়ার পরেও উৎপাদন খরচ না ওঠায় সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে কৃষক। উৎপাদন খরচ বেশি পড়ায় এখন তেভাগায় বর্গা চাষি পাওয়া যায় না। পথে কিছু কিছু জমিতে দেখা গেল মরিচ, পটল, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ হয়েছে। কৃষক ছালাম, গোপাল কুন্ডু, জয়নাল, আজিবর, রতন মৃধা জানালেন, ধানের দাম না পাওয়ায় অনেকেই এখন মরিচ, পটলসহ অন্যান্য ফসল আবাদ করেছেন। তারাও অন্য ফসল আবাদের কথা ভাবছেন। ডেমরা গ্রামের কৃষক শাহেদ আলী জানালেন, রোদে পুড়ে আর বৃষ্টিতে ভিজে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর ক্ষেতের ধানে সোনালি রঙ ধরেছে। পাকা ধান কাটতে ব্যস্ত কৃষক। কিন্তু বাম্পার ফলনে তাদের মুখে হাসি নেই।
সাঁথিয়ার ধুলাউরি হাটে একাধিক কৃষকের সাথে কথা হয়। এলাকার সম্ভ্রান্ত কৃষক হিসেবে পরিচিত জয়নুল আবেদীন ১৫ বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমির সেচ আড়াই হাজার টাকা, হালচাষ-রোপণে কৃষাণ তিন হাজার টাকা, সার-বীজ-নিড়ানি-কীটনাশক দুই হাজার ৫০০ টাকা, কাটা মাড়াই চার হাজার টাকা এবং পরিবহন বাবদ ৫০০ টাকা খরচ হয়েছে। সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে ১৪ হাজার টাকা। তিনি প্রতি বিঘা ধান পেয়েছেন গড়ে ২০ মন। যার বর্তমান বাজার মূল্য ১০ হাজার টাকা। অথচ উৎপাদন খরচ হয়েছে ১৪ হাজার টাকা। প্রতি বিঘা জমিতে তার লোকসান হয়েছে প্রায় চার হাজার টাকা।
কশিনাথপুর হাটে ধান বিক্রি করতে আসা মাসুমদিয়া গ্রামের কৃষক আব্দুস ছামাদ প্রামানিক জানান, তিন বিঘা জমিতে মিনিকেট ধান চাষ করে বিঘাপ্রতি ১৮ মন ফলন পেয়েছেন। বাজারে এ ধান ৭০০ টাকা মন দরে বিক্রি হচ্ছে। তিনি বলেন, দাদন নিয়ে ধান আবাদ করে বাজারে এসে পানির দামে ধান বিক্রি করতে হয়। নিজের জমিতে ধান আবাদ না করে লিজ দিয়ে দেব। স্বপ্ন ছিল এবার ধান বেঁচে মেয়ের বিয়ে দেব। কিন্তু পারছি না। বাবা হিসেবে এ দুঃখ রাখি কোথায় ?