শফিউল আযম, বেড়া (পাবনা) সংবাদদাতা ঃ
বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে তাঁতীরা ধরতে পারেনি পহেলা বৈশাখ ও ঈদুল ফিতরের বাজার। সারা বছরের পুঁজি হারিয়ে ধার-দেনা, ব্যাংক ঋণ ও দাদন নিয়ে কোন মতে ঊদুল আযাহার বাজার ধরার জন্য শাড়ি লুঙ্গি তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন তাঁত সমৃদ্ধ পাবনা-সিরাজগঞ্জের তাঁতীরা। ঠিক এমন সময়েই ‘মড়ার উপর খাড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে সর্বনাশা বণ্যা। একের পর এক দূর্যোগে সর্বস্বান্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছে তাদের। বেড়ার মথুড়া পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি ৩ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদ সীমার ৭১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তাঁত কারখানায় বণ্যার পানি ঢুকে পড়ায় তাঁতীদের পাওরলুমেরন্ত্রাংশই শুধু নষ্ট হয়নি, ব্যাংক ঋণ ও দাদনের টাকায় কেনা তাঁতের টানার সুতাও নষ্ঠ হয়ে হয়েছে। বণ্যার পানি ঢুকে পড়ায় প্রায় ১৫ হাজার তাঁত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।বেকার হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক শ্রমিক।
এদিকে অনেক পল্ট্রি খামারে বণ্যার পানি ঢুকে পড়ায় খামারিদের পানির দামে বয়লার, লেয়ার বিক্রি করতে হয়েছে। এতে তারা ব্যাপক লোকসানের শিকার হয়েছেন। তাঁতকারখানা মালিক, পল্ট্রি খামারি, বেকার তাঁত শ্রমিকসহ কয়েক লাখ বানভাসি পরিবারে নেই ঈদের আনন্দ।
অথচ প্রতি বছর ঈদ উল আযহাকে ঘিরে বাহারি নানা ডিজাইনের কাপড় বুনতে নির্ঘুম সময় পার করত শ্রমিকরা। তাঁতের চিরচেনা খট খট শব্দের মাঝে তাঁতিদের উচ্চকিত কন্ঠের গানে মুখরিত থাকতো পুরো তাঁত পল্লী। কিন্তু এবছর করোনাভাইরাসের প্রকোপে লকডাঊনের কারণে হাত ছাড়া হয়ে গেছে নববর্ষ ও ঈদুল ফিতরের বাজার। মজুত হয়ে আছে শত শত কোটি টাকার কাপড়। ঈদুল আযহার বাজার ধরার জন্য অনেক কারখানা মালিক ধারদেনা, দাদন ও ব্যাংক ঋণ নিয়ে পূঃণরায় কারখানা চালু করলেও ভয়াবহ বণ্যার কারণে প্রায় ১৫ হাজার তাঁত কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
গত রবিবার ও সোমবার (২৬ ও ২৭ জুলাই) দুই দিন সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার যমুনা নদী তীরবর্তী সহ¯্রাধিক গ্রাম বণ্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার জামিরতা, ভাটপাড়া, জগতলা, খুকনী, রুকনাই, জালালপুর, প্রাণনাথপুর, রুপপুর, রুপপুর নতুনপাড়া, উরিরচর, নগরডালা, বাদলবাড়ী, হামলাকোলা, ডায়া নতুনপাড়া, চরপেরজোনা, চৌহালী উপজেলার গোপিনাথপুর, শিবপুর, রুপনাই, গোপালপুর, এনায়েতপুর পুরানবাজার, খামারগ্রাম, ভাঙ্গাবাড়ী, পাবনা জেলার বেড়া উপজোর মালদাপাড়া, পেঁচাকোলা, উত্তর পেঁচাকোলা, রাকশা, সাফুল্যাপাড়া, বাটিয়াখরা, নেওলাইপাড়া, সোনাপদ্মা, রূপপুর, খানপুরা, সাঁথিয়া উপজেলার পাথালিয়াহাট, ছোটপাথালিয়াহাট, নগডেমরা, ফরিদপুর উপজেলার বড়ডেমরাসহ তাঁত সমৃদ্ধ অন্তত শতাধিক গ্রাম রয়েছে। করোনার কারণে দু’টি জেলায় আড়াই লাখ পাওয়ার লুম, তিন লাখ হস্তচালিত তাঁত, প্রক্রিয়াজাত রং এবং ডিজাইনের সাথে জড়িত প্রায় সাত লাখ তাঁত শ্রমিক এমনিতেই ধুঁকছিলেন। বন্যা তাঁদের পথে বসিয়েছে। বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে বসতঘরগুলো। সবচেয়ে বড় কথা হলো পানিতে ডুবে থাকায় তাঁতযন্ত্রগুলো অকেজো হয়ে পড়েছে। এখন তাঁরা জীবন জীবিকা নিয়ে অস্থির হয়ে পড়েছেন। তাঁতঘর, বসতঘর ও অকেজো তাঁত অন্য কোথাও সরিয়ে নেয়া ও মেরামতের চিন্তায় রয়েছেন তারা। এর সঙ্গে খাবার যোগাড়ের চিন্তা তো আছেই।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার চরপোরজনা গ্রামের হাতেগোনা ৮-১০টি তাঁত কারখানা ছাড়া প্রায় সবকটি কারখানায় বণ্যার পানি ঢুকেছে। কারখানায় হাটু পানির মধ্যে কেউ কেউ শাড়ী তৈরীর কাজ চালানোর চেষ্টা করছেন। তবে যমুনা নদীর পানি যেভাবে বাড়ছে তাতে আগামী ২-৩ দিনের মধ্যেই এসব কারখানার টানা ডুবে যাবে বলে তাঁত শ্রমিকেরা জানিয়েছেন। ওই গ্রামের তাঁত কারখানা মালিক আব্দুল্লাহ বললেন, করোনার জন্নি এমনিতেই আমাদেও আয়-রোজগার বন্ধ হয়া গেছিল। শেষ সম্বল দুই খানা দাদনে টেহা নিয়্যা চালু কইরা বাঁচার আশা করিছিল্যাম। কিন্তু বন্যায় সেই আশাও শেষ হয়া গেল।
প্রত্যান্ত উপজেলা চৌহালীর শিবপুর গ্রামের তাঁত শ্রমিক আবুল হোসেন জানালেন, গত বছর বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে তৈরি বিশেষ ডিজাইনের কাপড় বুণনের বিল দিয়ে তিনি এনজিওর ঋণ শোধ করেছিলেন। ঈদ মওসুমের কাজের বিল দিয়ে ঈদের কেনাকাটা আর বাড়তি খরচ করেছিলেন। কিন্তু এবছর ঈদুল-আযহায় ছেলেমেয়েদের নতুন জামাকাপড় তো দুরের কথা পেটের খিদে কিভাবে মিটাবেন তাই নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। বেলকুচির তাঁত শ্রমিক আবুল মন্ডল বললেন, প্রায় ১১ বছর ধরে আমি এনায়েতপুর পুরানবাজারে তাঁত শ্রমিক হিসেবে কাজ করছি। সারা বছর ধরে আমার মতো তাঁত শ্রমিকরা বাংলা নববর্ষ আর ঈদ মওসুমের অপেক্ষায় থাকি। এ সময়ের অতিরিক্ত আয় দিয়েই আমরা আমাদের সংসারের বাড়তি খরচ মেটাই। আর বছরের বাকি সময়ের বিল আমরা শুধু পেট চালাই। কিন্তু এ বছর সবকিছু ওলট-পালট করে দিয়েছে এই করোনাভাইরাস আর বণ্যা।
পাবনার বেড়া উপজেলার রাকশা গ্রামের আমিরুল আক্ষেপ করে বললেন, ‘ঈদের হাটের কথা চিন্তা করে কয়দিন আগে আমার পাঁচ খান তাঁত লুঙ্গি তৈরি করে আতাইকুলা ও শাহজাদপর হাটে বিক্রি করলাম। এহনতো তাঁতঘর ডুবে গেছে। ধার করে অনেক টাকার সুতা রং কিনিছিলাম সব শেষ। বউ পেলাপান নিয়ে অন্যের বাড়িতে রইছি। একেবারে সর্বস্বান্ত হয়া গেলাম।
বেড়ার হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর সিল্টু মিয়া বললেন, তার ইউনিয়নের ৪ নম্বর ও ৫ নম্বর ওয়াডের পেঁচাকোলা ও নতুন পেঁচাকোলা গ্রামে অন্তত পাঁচ-সাতশ তাঁতি পরিবার বন্যাদূর্গত। উপজেলার অন্যান্য গ্রামের আরও প্রায় তিন-চার হাজারের বেশি তাঁতিদেও একই অবস্থা। করোনার পর বণ্যার আঘাতে তাঁতিরা নিঃস্ব হওয়ার পথে। বণ্যায় ক্ষতিগ্রস্থ এসব এলাকার তাঁতীদের সরকারি কোন সহযোগীতা দেয়া হয়নি বলে তিনি জানিয়েছেন।
বেড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার আসিফ আনাম সিদ্দিকী বলেছেন, বণ্যাকবলিত তাঁতিদের বিষয়টি আমি অবশ্যই গুরুত্বসহকারে দেখব। বণ্যাকবলিতদের জন্য আলাদা কোনো ত্রাণ সহায়তা না এলেও ঈদ উপলক্ষে উপজেলায় বড় ধরনের ত্রাণ সহায়তা (ভিজিএফ) এর চাউল এসেছে। এসব ত্রাণ বিতরণে অসহায় তাঁতীদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।