শফিউল আযম ঃ
নদীর তলদেশ থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় যমুনার পশ্চিম পাড়ের ৫টি গ্রামে নদী ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিনই ২-১টি করে বসতবাড়ী ও ফসলী জমি, গাছপালা নদী গর্ভে বিলীন হচ্ছে। গত ছয় মাসের ভাঙনে প্রায় সাড়ে ৫০০টি বসতবাড়ী, ৬০০ একর ফসলি জমি, কমিউনিটি ক্লিনিকটি, প্রাথমিক বিদ্যালয়, পুরাতন বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধের আংশিকসহ অসংখ্য গাছপালা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এদিকে ভাঙনের হুমকীর মুখে পড়েছে জামে মসজিদ, কবরস্থান, চরপেঁচাকোলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ নির্মাণাধীন বণ্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ।
যমুনার পশ্চিম পাড়ে পাবনার বেড়ার চরপেঁচাকোলা এবং সিরাজগঞ্জ জেলার শাহাজাদপুরের গালা ইউনিয়নের দেওয়ায় তারটিয়া, পাইখন্দ, চরপাইখন্দ ও চিথুলিয়া গ্রামে অসময়ে যমুনায় ভয়াবহ ভাঙনের তান্ডবলীলা চলছে। ভাঙন আতঙ্কে নদী পাড়ের মানুষ নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। যমুনা নদীর পশ্চিমপাড় ঘেষে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় নদীর গভীরতা বেড়ে যাওয়ায় স্্েরাতধারা সরে এসে পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া নদীর বুকে বিশাল চর জেগে ওঠায় পানি প্রবাহ বাধা প্রাপ্ত হয়ে সরাসরি পশ্চিম পাড়ে আঘাত করছে। এতে পশ্চিমপাড়ের ৫টি গ্রামে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে।
গত সোমবার (২৯) এপ্রিল দুপুরে সরেজমিন ভাঙন এলাকা পরিদর্শন কালে চিতুলিয়া গ্রামের লাল মিয়া, মজিদ মোল্লা, আবুল মোল্লা, ছালাম মোল্লা, মোজাই মোল্লা, আরশেদ মোল্লা, অহেল মোল্লা, নূর মোহাম্মদ, ওয়াদুদ মন্ডল, চাঁদ মিয়া শেখ, মনিরুল ইসলাম, আফসার প্রামানিক, ছালাম মেম্বর, আকবর প্রামানিক, বুলবুলি, অর্চনা, রুবি, মোঃ আলেক প্রামানিক, সোরাব আলী, নওশের, ইয়াদ আলী, খোরশেদ আলীর সাথে কথা হয়। তারা জানান, গত ছয় মাসের অব্যাহত ভাঙনে তাদের বসতবাড়ীসহ প্রায় সাড়ে ৫০০টি বাড়ী, ৬০০ একর ফসলী জমি, কমিউনিটি ক্লিনিকটি, প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অসংখ্য গাছপালা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পুরাতন বাঁধে ঠাঁই না পেয়ে তারা অন্যের বাড়ী ও খোলা জায়গায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। চিতুলিয়া গ্রামের কাছে নির্মানাধীন নতুন বণ্যানিয়ন্ত্রন বাঁধ থেকে যমুনা নদী মাত্র ৬০০ ফুট দুর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদী ভাঙন অব্যাহত থাকায় নতুন বাঁধও ভাঙনের হুমকীর মুখে পড়েছে। ইতোমধ্যে পুরাতন বণ্যানিয়ন্ত্রন বাঁধের আংশিক নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
জানা যায়, যমুনার বুকে বিশাল চর জেগে উঠায় নদীর ¯্রােতধারা সরাসরি পশ্চিম পাড়ে আঘাত করছে। এছাড়া ড্রেজারের সাহায্যে নদীর পশ্চিমপাড় ঘেষে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করায় এই ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। চরপেঁচাকোলা গ্রামের আলহাজ্ব মাওলানা আব্দুল সোবহান, ডাক্তার চাঁদ আলী সরদার, মোঃ গোলাম মোস্তফা, আনিছুর রহমান, আলহাজ্ব আওরঙ্গজেব, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আলহাজ্ব আমিনুল ইসলাম, প্রধান শিক্ষক রতন কুমার দাস, শিক্ষক মিনহাজ উদ্দিন, শিক্ষিকা নাসরিন পারভীনসহ অনেকেই অভিযোগ করে জানান, চরপেঁচাকোলা গ্রামের কোল ঘেষে ড্রেজার মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোন করার ফারণে ভাঙন বন্ধ হচ্ছে না। তারা অভিযোগ করে বলেন, নদীর উত্তরপাড়ের বড়পায়না গ্রামের ক্ষমতাসীন দলের জনৈক প্রভাবশালী নেতার নেতৃত্বে একটি চক্র প্রতিদিন গভীর রাত থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত ৫০-৬০টি দেশি ড্রেজারের সাহায্যে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে আসছে। বালু উত্তোলনে বাঁধা দেয়ায় বড়পায়না গ্রামের চক্রটি গত শুক্রবার (২৬ এপ্রিল) চরপেঁচাকোলা গ্রামের নূর ইসলামের ছেলে আবুল কালাম একই গ্রামের মৃত- আজিজ মন্ডলের ছেলে আলাউদ্দিনকে (৩৫) হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করে। তাদেরকে মোহনগঞ্জ ও বেড়া বাজারে আসায়-যাওয়া বাধা দেয়াসহ মারপিট করা হয়।
চরপেঁচাকোলা গ্রামের প্রবীন ব্যক্তি আলহাজ্ব মাওলানা আঃ সোবহান জানান, গত ১৫ বছরে যমুনা নদী প্রায় দুই কিলোমিটার পশ্চিম প্রান্তে সরে এসেছে। এতে অনেক গ্রাম, মসজিদ, মন্দির, কবরস্থান, চিকিৎসা কেন্দ্র, হাট-বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাজার হাজার একর ফসলী জমিসহ অসংখ্য গাছপালা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। প্রায় ২৫ হাজার পরিবার সহায় সম্বল হারিয়ে বণ্যানিয়ন্ত্রন বাঁধসহ বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। যাদের আর্থিক সামর্থ আছে তারা অন্যত্র জমি কিনে ঘরবাড়ী তৈরি করে বসবাস করেছে। যাদের আর্থিক সামর্থ নেই তারা বণ্যনিয়ন্ত্রন বাঁধে আশ্রয় নিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
চিতুলিয়া গ্রামের বণ্যানিয়ন্ত্রন বাঁধে আশ্রিত আশরাফ আলী জানান, চরপেঁচাকোলা থেকে বিনোটিয়া পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার বণ্যানিয়ন্ত্রন বাঁধের উভয় পাশে চার সারিতে নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ সহায় সম্বলহীন অসহায় প্রায় ১৮ হাজার পরিবার বসবাসবাস করছে। এক সময়ের প্রশস্ত এই বাঁধটি এখন পায়ে হাঁটা মেঠো পথে পরিনত হয়েছে। বাঁধে আশ্রিত পরিবারগুলোর স্বাস্থ্য সম্মত পায়খানা নেই। খোলা আকাশের নীচে মলমূত্র ত্যাগ করছে। বিশুদ্ধ পানির তীব্র সঙ্কট রয়েছে। নদী, খাল, ও ডোবার পানি পান করে অনেকেই পেটের পীড়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আশরাফ আলী আরো বলেন, নির্বাচন এলে চেয়ারম্যান ও মেম্বর পদপ্রার্থীরা ভোটের জন্য বাঁধে আশ্রিতদের কাছে কাকুতি মিনতি করেন। সকল সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন। কিন্তু ভোটের পর আর তাদের দেখা পাওয়া যায় না। ইতোমধ্যে পুরাতন বণ্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধের আংশিক নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ায় বাঁধে বসবাসকারীদের মাঝে ভাঙন আতঙ্ক বিরাজ করছে।
চরপেঁচাকোলা গ্রামের প্রবীণ লোক মজিদ মোল্লা। গত এক যুগে দুই দফা নদী ভাঙনের শিকার হয়েছেন। এক সময় তার ২০ বিঘা জমি ও সাজানো ঘরবাড়ী ছিল। এখন কিছুই নেই, সবই যমুনা নদীতে বিলীন হয়েছে। পরিবার পরিজন নিয়ে বণ্যানিয়ন্ত্রন বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। বেড়া পৌর সদরে শ্রমিকের কাজ করে কোনরকম চলছে পাঁচ সদস্যের সংসার। ‘অনেক জমিজমা গাছপালা আছিল এহন আর কিছুই নাই। সর্বনাশা যমুনা নদী আমাগো শেষ সম্বলটুকুও কাইরা নিছে’। এই বলেই কেঁদে ফেললেন মজিদ মোল্লা।
শাহজাদপুর উপজেলার গালা ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের প্রাক্তন ইউপি সদস্য মোঃ আব্দুস ছালাম জানান, গত এক মাসের ভাঙনে দেওয়ান তারটিয়া গ্রামের আংশিক, পাইখান্দ গ্রামের ২৫টি বাড়ী, চক পাইখান্দ গ্রামের ২০টি বাড়ী, একটি জামে মসজিদ ও একাট কবরস্থান এবং চিথুলিয়া গ্রামের ১৮টি বাড়ীসহ শতাধিক বিঘা ফসলী জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। একই ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের মহিলা সদস্য মোছাঃ আলেয়া খাতুন জানান, চিথুলিয়া গ্রামের একমাত্র মন্দিরটি নদীতে বিলীন হয়েছে। ভাঙন কবলিত গ্রাম গুলোতে প্রায় ৬০০ পরিবারের বসবাস ছিল। ভাঙন আতঙ্কে গ্রামের বাসিন্দারা বাড়ীর ভিটে থেকে ঘর ভেঙ্গে অন্যাত্র সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
বেড়া উপজেলার হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের মেম্বর চরপেঁচাকোলা গ্রামের বাসিন্দা মো. মিজানুর রহমান বলেন, গত বছরের আগষ্ট মাস থেকে শুরু হওয়া ভয়াবহ নদী ভাঙনে শুধুমাত্র চরপেঁচাকোলা গ্রামের তার বাড়ীসহ প্রায় ৩০০ শতাধিক বাড়ী, একটি মাদ্রাসা, মসজিদ একটি কমিউনিটি ক্লিনিকসহ প্রায় ২০০ একর ফসলী জমি, অসংখ্য গাছপালা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মাত্র কয়েক দিনে এ গ্রামের প্রায় ৩০ বিঘে ফসলি জমি নদীতে ভেঙ্গে গেছে। এছাড়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, কবরস্থান ও মাদ্রাসা ভাঙনের হুমকীর মুখে পড়েছে।
বেড়া পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আব্দুল হামিদ জানান, চরপেঁচাকোলা ও চিতুলিয়া গ্রামে যমুনা নদীর ভাঙনরোধ কাজের জন্য প্রায় চার কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এই কাজের দরপত্র আহবান করা হয়েছে। দরপত্র যাচাই-বাছাইয়ের পর ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রায় চুড়ান্ত করা হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই ভাঙন প্রতিরোধে কাজ শুরু করা হবে।