ব্রক্ষপুত্র ও তিস্তায় কমেছে প্রবাহ; যমুনায় জেগেছে বিস্তীর্ণ চর

0
357

শফিউল আযম, বেড়া (পাবনা) সংবাদদাতা ঃ
ভারতের উৎসমুখ থেকে আসা ব্রক্ষপুত্র ও তিস্তা নদীর প্রবাহ একসঙ্গে ধারন করে যমুনা নদী বিশাল জলরাশি নিয়ে বির্স্তীর্ণ জনপদের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভারত তিস্তা ও ব্রক্ষপুত্রের নদের পানি নিয়ন্ত্রন করায় ভাটির বাংলাদেশ অংশে পানি প্রবাহ কমে গেছে। এর বিরুপ প্রভাবে যমুনা নদীর বুকে বিশাল বিশাল স্থায়ী চর ও ডুবোচর জেগে উঠেছে। নদীর মূলধারা সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ছে। যমুনা সংযুক্ত ২০টি শাখা-প্রশাখা নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। জীববৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক পরিবেশ, পানিসম্পদ, কৃষি ও নৌপথে যোগাযোগ হুমকীর মুখে পড়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, পৃথিবীর বৃহত্তম নদীগুলোর অন্যতম ব্রক্ষপুত্র নদের উৎপত্তি তিব্বতের মানস সরোবরের নিকট চেমাইয়াংডুং হিমবাহে। তিব্বতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এক হাজার ৪৪৩ কিলোমিটার। ব্রক্ষপুত্র নদ উত্তর-পূর্বে পুরো আসামের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ৮০১ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে আসামের ধুবড়ি শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দক্ষিন-পূর্ব কোণে কুড়িগ্রাম জেলার উত্তর-পূর্ব কোণ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। কুড়িগ্রাম, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা জেলার পূর্ব প্রান্ত দিয়ে প্রবাহমান ছিল।
পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার সীমান্তে ব্রক্ষপুত্র নদ পুরানো খাত পরিবর্তন করে নতুন খাতে প্রবাহিত হতে আরম্ভ করে। এই খাতকে বলা হয় যমুনা বা নতুন ব্রক্ষপুত্র। এই নতুন প্রবাহ বেড়া উপজেলার ঢালারচর ইউনিয়নের নতিবপুরের বারকোদালিয়া নামক স্থানে পদ্মায় মিশেছে। ব্রক্ষপুত্র নদের এই পরিবর্তন ঘটেছে ১৭৮৭ সালের ভয়াবহ মহাপ্লাবনের সময়। এ সময় তিস্তা ও আত্রাই নদীর গতি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়ে যায়। তিস্তা নদী আগে এসে পড়ত পদ্মায়; কিন্তু তখন থেকে পড়তে থাকে ব্রক্ষপুত্রে।
যমুনার একটি শাখা পুরাতন ব্রক্ষপুত্র নাম ধারন করে মোমেনশাহী জামালপুরের ভেতর দিয়ে ভৈরব বাজারের নিকট মেঘনা নদীতে পড়েছে। উৎপত্তিস্থল থেকে ব্রক্ষপুত্র যমুনার মোট দৈর্ঘ দুই হাজার ৫২১ কিলোমিটার। বাংলাদেশ অংশে এর দৈর্ঘ ২৭৭ কিলোমিটার। ব্রক্ষপুত্র প্রতি বছর গড়ে ৫২৭ মিলিয়ন টন পলি বহন করে। ব্রক্ষপুত্র নদ থেকে বাংলাদেশ ৭০ শতাংশ পানি পেয়ে থাকে। বাংলাদেশে ব্রক্ষপুত্র যমুনার উপনদী ও শাখা প্রশাখার মধ্যে রয়েছে তিস্তা, ধরলা, করতোয়া, আত্রাই, হুড়াসাগর, সুবানসিঁড়ি, পুরাতন ব্রক্ষপুত্র, ধলেশ্বরী, পৌলী, দুধকুমার, ধরিয়া, ঘাঘট, কংশ, সুতলা প্রভৃতি। এসব নদীর অববাহিকা হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বিস্তৃত অববাহিকা। যমুুনা নদীর মৃত্যু হলে এসব নদীও হারিয়ে যাবে।
ভারত তিস্তা নদীকে কেন্দ্র করে গজলডোবার উজানে ২০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যওে মোট পাঁচটি ক্যানেল বা খাল খনন করেছে। এগুলো হলো, তিস্তা-মহানন্দা মূল ক্যানেল, মহানন্দা প্রধান ক্যানেল, ডাউক নগর প্রধান ক্যানেল, নাগর টাঙ্গন প্রধান ক্যানেল এবং তিস্তা-জলঢাকা প্রধান ক্যানেল। ক্যানেলের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশ অংশে তিস্তার প্রবাহ কমে গেছে। এর বিরুপ প্রভাবে যমুনা নদী সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়েছে। আর নদীর বুক ভরাট হয়ে বিশাল বিশাল চর পড়েছে। চরে ফলছে নানা রকম ফসল; গড়ে উঠেছে স্থায়ী বসতী। যমুনার ২০টি শাখা-উপশাখা নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। এতে যমুনা তীরের এলাকাগুলোর পরিবেশ রুক্ষ রুপ ধারন করবে। যা কৃষিক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিসাধন করবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বণ্যার ধরনে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে। ফলে নদীনির্ভর চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। ফসল উৎপাদনে পড়ছে বিরুপ প্রভাব।
যমুনা নদী পাড়ে এখন আর গাঙচিল বেলেহাঁস আর ধবল বক দেখা যায় না। দৃষ্টিতে আসে না অন্যান্য পাখি। নদীতে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় মাছ প্রায় শুন্য। যে কারণে সাদা বক গাঙচিল আর বেলেহাঁসের দেখা পাওয়া যায় না। যমুনায় আগের মতো পাঙ্গাস, চিতল, আইড়, গুজো ও রিঠা মাছ পাওয়া যায় না। পাঙ্গাস আইড়, চিতল মাছের বিচরনক্ষেত্র ছিল রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া থেকে কুড়িগ্রামের চিলমারি পর্যন্ত। মাছ আসার জন্য নদীতে পানির যে পরিমান প্রবাহ থাকার কথা সেটি না থাকায় এখন আর যমুনায় পাঙ্গাস, চিতল, আইড়সহ সুস্বাদু মাছ আসে না।
উজানে পানি প্রত্যাহারের কারণে দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার উপর দিয়ে বয়ে চলা ইছামতি, জলঢাকা, সতী, ঘাঘট, ফুলকুমার, ধুম, বুড়িঘোড়া, নলেয়া, রায়ঢাক, আলাই, কাঁটাখালি, সাবমারা, লহিত, চিতনী, মরাকরতোয়া, সানিয়াজান, তিস্তা, ঘাঘট, ছোটযমুনা, নীলকুমার, বাঙালী, বড়াই, মানস, কুমলাই, সোনাভরী, হলহলিয়া, জিঞ্জিরাম, বুড়িতিস্তা, যমুনেশ্বরী, মহানন্দা, টাঙ্গান, কুমারী, রতœাই, পূনর্ভবা, ত্রিমোহনী, তালমা, ঢেপা, কুরুম, কুলফি, বালাম, ভেরসা, ঘোড়ামারা, মালদহ, চারালকাঁটা, পিছলাসহ ৫০টি নদী নব্যতা হারিয়ে মরা খালে পরিনত হয়েছে। অনেক নদী শুকিয়ে গেছে। এ অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। তিস্তায় পর্যাপ্ত পানি না পাওয়ায় দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা প্রকল্পে কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। প্রতি বছর শুস্ক মওসুমে সেচ প্রকল্প এলাকায় সাত লাখ হেক্টর জমিতে পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দেয়। এ কারণে গত কয়েক বছরে এই অঞ্চলের হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে হচ্ছে, যা এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে ক্রমাগত পঙ্গু করে দিচ্ছে।
এদিকে যমুনা সেতুর তলদেশে উজান ও ভাটিতে বিশাল বিশাল স্থায়ী চর পড়েছে। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটির নিচে মাঝ বরাবর পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ স্থায়ী চর পড়েছে। সেতুর নিরাপত্তার জন্য ধলেশ্বরী নদীর উৎস মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাজার হাজার হেক্টর জমি। যমুনা সেতু নির্মানের ফলে বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষের উপকার হয়েছে। সেতু নির্মানের সময় এক সমীক্ষায় বলা হয়েছিল ধলেশ্বরী নদীর উত্তর উৎস মুখ বন্ধ হলে এর বিরুপ প্রভাব পড়বে ৬০ হাজার ৭০০ হেক্টর এলাকায়। সমীক্ষার সমস্ত সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে খোদ যমুনা নদীই মরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ধলেশ্বরী নদীর উৎস মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার একর জমি সেচ সঙ্কটে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, প্রকৃতিগত দিক দিয়ে নদী বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বুনিয়াদ। পেশাগত দিক থেকে জীবন-জীবিকার একটি অংশ নির্ভরশীল এ দেশের নদ-নদীর ওপর। এ দেশের কৃষি সম্পদ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যবসা-বানিজ্য, পরিবেশ- এর সবই নদীনির্ভর। নদীকে বাদ দিয়ে এদেশের উন্নয়ন তথা মানুষের জীবন কল্পনাই করা যায় না। সংখ্যার দিক থেকে মতপার্থক্য থাকলেও কমপক্ষে চার শতাধিক নদ-নদী জালের মতো বিস্তার করে আছে পুরো দেশে। নদী বিশেষজ্ঞদের অভিমত, শুকনো মওসুমে ব্রক্ষপুত্র নদ বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ পানির উৎস। এই নদী দিয়ে পানি আসা কমে গেলে বাংলাদেশের কৃষি ও পরিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here