যমুনা নদীতে নাব্যতা সঙ্কট অব্যাহত বাঘাবাড়ী বন্দরে জ্বালানী তেল ও পণ্যসামগ্রী আমদানি-রফতানি অনেক কমেছে

0
396

শফিউল আযম ঃ
বাঘাবাড়ী নৌবন্দরের ছয় কিলোমিটার ভাটিতে বেড়ার মোহনগঞ্জ থেকে নগরবাড়ী পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার ব্যাপী যমুনা নদীতে নাব্যতা সঙ্কট মারাত্মক আকার ধরন করেছে। জ্বালানী তেল ও রাসায়নিক সারসহ অন্যান্য পণ্যবাহী জাহাজ ধারণক্ষমতার অর্ধেক মালামাল নিয়ে বাঘাবাড়ী বন্দরে আসছে। এতে বন্দরে পণ্যসামগ্রী আমদানি-রফতানি স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কমে গেছে। এদিকে আমদানীর তুলনায় চাহিদা বেশি হওয়ায় অয়েল ডিপোর আপদকালীন মজুদ থেকে জ্বালানী তেল সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে আপদকালীন মজুদ কমে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
বাঘাবাড়ী বন্দরের সহকারী পরিচালক এস এম সাজ্জাদুর রহমান জানিয়েছেন, দৌলতদিয়া-বাঘাবাড়ী নৌপথে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলাসহ ১৯ জেলায় জ্বালানী তেল, রাসায়নিক সারসহ অন্যান্য পণ্যসামগ্রী পরিবহনের একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর মাধ্যম। এ নৌপথে জ্বালানী তেলবাহী ট্যাংকার, রাসায়নিক সার ও বিভিন্ন পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ চলাচল করে। বাঘাবাড়ী বন্দর থেকে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, নীলফামারী, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর, চাপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী টাংগাইল, ময়মনসিং ও জামালপুর জেলার চাহিদার ৯০ ভাগ জ্বলানী তেল ও রাসায়নিক সার সরবরাহ করা হয়। আবার এ অঞ্চল থেকে বাঘাবাড়ী বন্দরের মাধ্যমে চাল ও গমসহ অন্যান্য পণ্যসামগ্রী রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়। নাব্যতা সঙ্কটে বন্দরে আমদানি রফতানি অনেক কমে গেছে। এ নৌ চ্যানেলের মোহনগঞ্জ ও পেঁচাকোলা পয়েন্টে নাব্যতা সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বিআইডাব্লিউটিএ নৌ চ্যানেলের নাব্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য ড্রেজিং কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
জানা যায়, যমুনা নদীতে ডিসেম্বরের শুরু থেকে নাব্যতা সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বর্তমানে এই সঙ্কট মারাত্মক আকার ধারন করেছে। জ্বালানী তেল ও পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের জন্য পানির গভীরতা প্রয়োজন হয় ১০ থেকে ১১ ফুট। বাঘাবাড়ী বন্দরের ছয় কিলোমিটার ভাটিতে মোহনগঞ্জ থেকে নগরবাড়ী পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার এলাকার কোথাও কোথাও পানির গভীরতা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ছয় থেকে সাত ফুট। বিপিসি সূত্র জানা যায়, নভেম্বর মাসে ১০ লাখ লিটার জ্বালানী তেল নিয়ে জাহাজ বাঘাবাড়ী বন্দরে এসেছে। ডিসেম্বরে তা কমে দাঁড়িয়েছিল সাত লাখ লিটারে। নাব্যতা সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করায় চলতি জানুয়ারি মাস থেকে বাঘাবাড়ী নৌচ্যানেল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। দৌলতদিয়ায় ও পটুরিয়ায় কার্গো জাহাজ থেকে পণ্যসামগ্রী লাইটারেজ করে ছোট ছোট ট্রলারে বাঘাবাড়ী বন্দরে নিয়ে আসা হচ্ছে। এ কারণে বন্দরে জ্বালানী তেলসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর আমদানি রফতানি অনেক কমে গেছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলার ডিষ্ট্রিবিউটর এজেন্ট অ্যান্ড পেট্রোল পাম্প ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের রাজশাহী বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেছেন, উত্তরাঞ্চলে প্রায় পাঁচ শতাধিক পেট্রোল পাম্প, তিন শতাধিক ডিলার এবং পাঁচটি ডিজেল চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে। নাব্যতা সঙ্কটে আন্ডারলোড নিয়ে জ্বালানী তেলবাহী জাহাজ বাঘাবাড়ী বন্দরে ভীড়ছে। তিনটি কোম্পানিতে জ্বালানী তেলের আমদানি কমেছে। সেচ মওসুমে বাঘাবাড়ীর ডিপোর পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা এই তিনটি কোম্পানি থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ লিটার জ্বালানী তেল সরবরাহ করা হয়। প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার এই চাহিদা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫-৫০ লাখ লিটারে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি উত্তরাঞ্চলে জ্বালানী তেলের সঙ্কট দেখা দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে সেচনির্ভর বোরো আবাদে এবং বিদু্যুৎ উৎপাদনে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
বিসিআইসির বাঘাবাড়ি বন্দরের বাফার গুদামের একটি সূত্র জানিয়েছে, বাঘাবাড়ী বন্দর রাসায়নিক সার পরিবহনের ট্রানজিট পয়েন্টে। সেখান থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার বস্তা রাসায়নিক সার সড়ক পথে উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় ১৪টি বাফার গুদামে সরবরাহ করা হয়। যমুনা নদীর নাব্যতা সঙ্কটে রাসায়নিক সারভর্তি জাহাজ পূর্ণলোড নিয়ে বাঘাবাড়ী বন্দরে আসতে পারছে না। বন্দরের ৪০-৪৫ কিলোমিটার ভাটিতে পাটুরিয়া, দৌলতদিয়া পয়েন্টে জাহাজ থেকে সারসহ অন্যান্য পণ্যসামগ্রী আনলোড করে ছোট ছোট নৌকা ও ট্রলারে বাঘাবাড়ী বন্দরে নিয়ে আসা হচ্ছে। এতে বাফার গুদামগুলোতে আপদকালীন সারের মজুদ গড়ে তোলার কাজ বিঘিœত হচ্ছে। এছাড়া জাহাজ প্রতি পরিবহন ব্যয় বেড়েছে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। এতে ব্যবসায়ীরা বাঘাবাড়ী বন্দরের মাধ্যমে পণ্যসমাগ্রী আমদানি রফতানি কমিয়ে দিয়েছে। বর্তমানে তারা নগরবাড়ী বন্দরের মাধ্যমে পণ্যসামগ্রী আমদানি-রফতানি করছে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাবনা হাইড্রোলজি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ব্রক্ষপুত্র ও তিস্তা নদীর প্রবাহ একসঙ্গে ধারন করে বিশাল জলরাশি নিয়ে যমুনা নদী বির্স্তীর্ণ জনপদের ভেতর দিয়ে প্রবাহমান। সেচ মওসুমে ভারত তিস্তা ও ব্রক্ষপুত্র নদের পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় বাংলাদেশ অংশে ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীতে পানি প্রবাহ অনেক কমে গেছে। এর বিরুপ প্রভাব পড়েছে যমুনা নদীতে। ফলে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় যমুনা নদীতে নাব্যতা সঙ্কট প্রকট আকার ধারন করেছে। ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীতে পানি প্রবাহ হৃস অব্যহত থাকে তাহলে যমুনা নদীতে নাব্যতা সঙ্কট মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএ আরিচা অফিসের দায়িত্বশীল একটি সূত্রে জানিয়েছে, রাসায়নিক সার ও পণ্যবাহী জাহাজ চলাচলের জন্য ১০ থেকে ১১ ফুট পানির গভীরতা প্রয়োজন হয়। সেখানে এই নৌ চ্যানেলের নগরবাড়ীর উজান থেকে মোহনগঞ্জ পর্যন্ত পানির গভীরতা রয়েছে মাত্র ছয় থেকে সাত ফুট। নৌ-চ্যানেলের ওই পয়েন্টে চরের পরিধি বেড়ে গেছে। কমে গেছে পানির গভীরতা। প্রতিদিন পদ্মা-যমুনা নদীতে পানি কমা এবং বালির প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় নাব্যতা সঙ্কট আরো প্রকট আকার ধারণ করতে পারে বলে বিআইডব্লিউটিএ’র ওই সূত্র আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
আরিচা অফিসের ওই সূত্র আরো জানিয়েছে, প্রতি বছর এসময় দৌলতদিয়া-বাঘাবাড়ী নৌচ্যানেলে নাব্যতা সঙ্কট দেখা দেয়। নগরবাড়ীর উজানে ছয় থেকে সাত ফুট পানির গভীরতা রয়েছে। পদ্মা ও যমুনা নদীতে প্রতিদিন পানি কমছে। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলাসহ ১৯ জেলার জ্বালানীতেল ও রাসায়নিক সার সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য বিআইডাব্লিউটিএ কাজ করে যাচ্ছে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাত এই নৌ-চ্যানেল সচল রাখার জন্য নগরবাড়ীর উজানে মোহনগঞ্জে ড্রেজিং করে পলি অপসারন করা হচ্ছে। এদিকে বালির প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় ড্রেজিং করার পর ভাটিতে পলি পড়ে ডুবোচরগুলো আগের স্থানে ফিরে যাচ্ছে। ড্রেজিং করে পলিমাটি নদীতে ফেলায় এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এতে শুধু টাকার অপচয় ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না বলে স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here