সাঁথিয়ায় প্রসেস মিলের বিষাক্ত বর্জ্যে হুমকীর মুখে জন স্বাস্থ্য ও পরিবেশ পিপুলিয়া গ্রামেই গড়ে উঠেছে ৩টি সুতা প্রসেস মিল অ্যান্ড ডাইং কারখানা

0
337

শফিউল আযম, বেড়া (পাবনা) সংবাদদাতা:পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার পিপুলিয়া গ্রাম। পৌর সদরের অবস্থিত এই গ্রামে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে তিনটি প্রসেস মিল এন্ড ডাইং কারখানা। এই কারখানার বিষাক্ত তরল বর্জ্য পরিবেশ দূষনের মারাতœক কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারখানার নির্গত বিষাক্ত তরল বর্জ্যরে ক্ষতিকর প্রভাবে এলাকার মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। প্রসেস মিল এন্ড ডাইং কারখানার নির্গত বর্জ্য তিনটি খালে ফেলা হচ্ছে। এতে খালের পানি কালো বর্ণ ধারন করেছে। বৃষ্টিতে খালের পানি উপচে ফসলী জমিতে গিয়ে পড়ছে। কারখানার বিষাক্ত তরল বর্জ্যরে পঁচা দুর্গন্ধে গ্রামে বাসবাসকারীদের চরম দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এ পথে পথচারীদের নাকে কাপড় দিয়ে চলাচল করতে হয়।

স্থানীয়দের অভিযোগ জানা যায়, সাঁথিয়া পৌর এলাকার পিপুলিয়া গ্রামের মধ্য ও পূর্বপাড়ায় অবস্থিত ৩টি প্রসেস অ্যান্ড ডাইং কারখানার মালিক ইন্তাজ মল্লিক, মন্তাজ মল্লিক (দুই ভাই) ও মকলেছুর রহমান ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বা বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) স্থাপন করেনি। তারা পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর সুতা প্রসেস ও রংয়ের কাজ অব্যাহত রেখেছে। সুতা রংয়ের কাজে এসিড, কস্টিক সোডা, ব্লিচিং পাউডারসহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। সুতা রংয়ের কারখানার তরল বর্জ্যরে তীব্র পঁচা গন্ধ বাতাসে মিশে আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ায় জন স্বাস্থ্য হুমকীর মুখে পড়েছে।

পিপুলিয়া গ্রাম সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সুতা প্রসেস অ্যান্ড ডাইং কারখানা কেমিক্যাল বর্জ্যের ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বা বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) নেই। নেই বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য কোন সংরক্ষিত হাউস। প্রসেস মিলের বয়লার ও ডাইং কারখানা থেকে পাইপের সাহায্যে দুষিত তরল বর্জ্য নির্গত হয়ে খালে জমা হচ্ছে। খালের বর্জ্য অপর পাইপের সাহায্যে ভূগর্ভে চলে যাচ্ছে। এতে ভূগর্ভস্তরের পানি দূষিত হচ্ছে। অনেকেই নিরুপায় হয়ে এই বিষাক্ত পানি পান করে চর্মরোগ, পেটেরপীড়াসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। আবার বৃষ্টির সময় খাল উপচে বিষাক্ত পানি আশপাশের ফসলের জমিতে ছড়িয়ে পড়ছে। একটি কারখানার পাশের খালে রাসায়নিক মিশ্রিত তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। ওই এলাকার বেশ কিছু অগভরি নলকুপে দুর্গন্ধযুক্ত পানি উঠছে। রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার জনিত ধোঁয়ায় গাছপালার ক্ষতি হচ্ছে।

পিপুলিয়া গ্রামের প্রভাবশালী প্রসেস মিল এন্ড ডাইং কারখানা মালিকদের ভায়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলেজ ছাত্র জানান, তার বাড়ির পাশে সুতা প্রসেস কারখানা থাকায় তাকে বিষাক্ত পরিবেশের মাঝে বসবাস করতে হচ্ছে। তরল বর্জ্যরে ঝাঁঝাঁলো দুর্গন্ধযুক্ত বাতাসে এলাকার পরিবেশ বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। আবার কারখানা মালিকেরা প্রভাবশালী হওয়ায় অনেকেই তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পায় না। এ নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে চাঁপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। প্রসেস মিল মালিকদের সাথে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ফলে প্রশাসনে অভিযোগ করে কোন প্রতিকার পাওয়া তো দুরের কথা উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয়।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এলাকার প্রভাবশালী প্রসেস অ্যান্ড ডাইং কারখানার মালিকরা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বছরের পর বছর ধরে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এই ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে এসব প্রসেস মিল অ্যান্ড ডাইং কারখানার ব্যবসা। এলাকার সচেতন মহল অবিলম্বে এসব প্রসেস মিল অ্যান্ড ডাইং কারখানা জনবসতিহীন এলাকায় স্থানান্তরের দাবি জানিয়েছেন।

এ বিষয়ে সাঁথিয়া পৌরসভার মেয়র মোঃ মিরাজুল ইসলাম বলেছেন, এ ব্যাপারে কেউ কোন অভিযোগ করেনি। ঘণবসতি এলাকায় প্রসেস মিল বসানোর কোন বিধান নেই। প্রসেস মিলের তরল বিষাক্ত কেমিক্যাল বর্জ্য খালে ফেলায় খালের পানি ও পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। যদি প্রসেস মিল মালিকদের পরিকল্পিতভাবে কেমিক্যাল বর্জ্য পরিশোধন করে নির্দিষ্ট স্থানে বর্জ্য নিস্কাশন করে, তাহলে দুষনের কবল থেকে পরিবেশ ও জন স্বাস্থ্য যেমন রক্ষা পাবে, তেমনি প্রসার ঘটবে এলাকার তাঁত শিল্পে।
প্রসেস মিলের মালিক ইন্তাজ মল্লিক সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানিয়েছেন, ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বা বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপি) স্থাপন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বর্তমানে কারখানার তরল বর্জ্য নিরাপদ স্থানে খালে ফেলা হচ্ছে। এতে জন স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ক্ষতির কোন আশঙ্কা নেই। প্রসেস মিলের তরল বিষাক্ত বর্জ্য পাইপের সাহায্যে ভূগর্ভস্তরে গিয়ে পানি দূষিত করছে এ প্রসঙ্গে তিনি কোন মন্তব্য করেননি।

মেডিসিন বিষেঞ্জ ডা. এনসুর রহমান জানিয়েছেন, প্রসেস মিল অ্যান্ড ডাইং কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যের কারণে টিউবওয়েলের পানিতে কলিফর্ম নামক জীবাণু জন্মায়। এই পানি খাওয়ায় এলাকার মানুষ চর্মরোগ, পেটেরপীরাসহ নানা জটিল আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া লিভার, কিডনি, ফুসফুস, হৃদযন্ত্রসহ মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
সাঁথিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সঞ্চিব ঘোষস্বামী মোবাইল ফোনে জানিয়েছেন, প্রসেস মিলের তরল বিষাক্ত ক্যামিক্যাল বর্জ্যরে কারনে মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়। এর প্রভাবে জমির সফল উৎপাদন ক্ষমতা অনেক কমে যায়। ক্ষেতের বিভিন্ন ফসলের চারা বড় হওয়ার আগেই কালছে রং ধারণ করে মরে যায়। এতে কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হন। তবে এ ব্যাপারে অভিযোগ পেলে প্রয়োজনী ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

সাঁথিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার এস এম জামাল আহম্মেদ মোবাইল ফোনে এ প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন, এ বিষয়ে কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তবে এন্তাজ ও মোন্তাজের নাম তিনি শুনেছেন। প্রসেস মিল অ্যান্ড ডাইং কারখানাগুলো সরেজমিন পরিদর্শনের জন্য লোক পাঠাবেন। যদি দেখা যায় কারখানাগুলোর কারণে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here