শফিউল আযম ঃ
এলাকার নাম হাঁড়িয়াল। ইংরেজরা ওদের ভাষার মতো নাসিকা ধ্বনিতে উচ্চারন করত ‘হান্ডিয়াল’। বাঙালীরা শ্বেতপ্রীতি লাভে বলত হান্ডিয়াল। ব্যস, হয়ে গেল হান্ডিয়াল। সেদিনের এই জনপদ আজ সম্প্রীতির বন্ধন। পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার শেষ সীমানা হান্ডিয়াল চলনবিলের দক্ষিণপাড়কে করেছে সমৃদ্ধ। ইতিহাসের দর্শনীয় নানা স্থাপনা বিলপারের নিভৃত প্রান্তরের প্রাকৃতিক দৃশ্যে মন ছুঁয়ে যায়। বড়াল নদীর তীর ও বিলপারের চাটমোহর নিয়ে আছে একটি গল্প। পঞ্চদশ শতকে এই এলাকায় সোনার মোহর বেচাকেনা হতো। ছিল ডাকাতের উপদ্রব। কারবারিরা ডাকাতের ভয়ে চটের থলিতে মোহর ভরে আনতো। পরে চটের থলি আর মোহর একত্রিত হয়ে স্থানীয়দের মুখে নামকরণ হয় চাটমোহর। তবে এর সত্যতার সন্দেহ দুর করে দিয়েছে বাংলাদেশ তথ্য বাতায়ন (জুন’১৪)।
চাটমোহরের অনেক প্রসিদ্ধ স্থাপনার একটি চৌধুরীবাড়ী। এই বাড়ীর রয়েছে আরেক পরিচয়। তা হলো- জোড়াসোঁকোর ঠাকুরবাড়ীর কবিগুরু রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবারের সাথে সাহিত্যের দিকপাল প্রমথ চৌধুরীর পরিবারের আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। চাটমোহরে বাঙালী সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ইতিহাসের অনেক অধ্যায়ের চিহেৃর এক বড় কীর্তি হান্ডিয়াল।
চাটমোহরের শেষ সীমানা হান্ডিয়ালের অপরপ্রান্তে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা। তাড়াশের নামটি এসেছে ত্রাস শব্দ থেকে। ব্রিটিশ শাসনামলে ত্রাসের জ্বালায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল অতিষ্ঠ। ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ বণিকদের আবেদনে হান্ডিয়ালে থানা স্থাপন করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৪৯ সালে থানা সদর চলে যায় হান্ডিয়াল থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দুরে চাটমোহরে। বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে চাটমোহর উপজেলার পরিচিতি পায়। একদার দূর্গম-বন্ধুর পথ চলনবিলের এখন অনেক সড়ক পাকা। চাটমোহর থেকে মান্নাননগর পর্যন্ত বাঁধের ওপর দিয়ে পাকা সড়ক হয়েছে। সেখান থেকে দুই কিলোমিটার দুরে হান্ডিয়াল।
এই হান্ডিয়াল লালন করছে বুড়াপীরের মাজার, শাহীপথ, জগন্নাথের মন্দির, গোপীনাথের মন্দির ও বিগ্রহ মন্দির, দোল মঞ্চ, শেঠের বাংলোসহ নানান স্থাপত্য। বুড়াপীরের মাজারের আরেক পরিচয় বারো আউলিয়ার সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি ছিলেন একজন পীর, যিনি বুড়াপীর নামে পরিচিতি পান। প্রন্ততত্ত্ব অধিদফতর মাজারটি সংরক্ষণ করেছে। হান্ডিয়ালের জগন্নথ মন্দিরের নক্্রা স্থাপত্যশৈলীতে সেই যুগেও আধুনিক মাত্রা এনে দেয়। মন্দিরের একাংশের দেয়ালে পোড়ামাটির ফলক (টেরাকোটা) ইতিহাসের কয়েককালের পরিচয় দিয়েছে। গত শতাব্দীর শেষদিকে জগন্নাথ মন্দিরের পাশেই একই নক্্রায় আরেকটি মন্দির নির্মিত হয়েছে। এই মন্দিরের নামও জগন্নাথ মন্দির। কাছাকাছি স্থানে আছে গোপীনাথের মন্দির ও বিগ্রহ। বছরের নির্দিষ্ট তিথিতে গোপীনাথ মন্দিরের বিগ্রহ এক মন্দির থেকে আরেক মন্দিরে রাখা হয়। সারা বছর ওই বিগ্রহ থাকে। হান্ডিয়াল মন্দির থিরে ওই এলাকার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থভূমিতে পরিনত হয়েছে। মন্দিরের কাছে দোল মঞ্চ এবং শাহী পথ তীর্থযাত্রীদের মিলনমেলায় রুপ নিয়েছে।
শেঠেরবাংলো কার্যত এখন একটি মন্দির। যে স্থাপনা স্মরণ করিয়ে দেয় বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিশ্বাসঘাতক সহচর জগৎশেঠ গংকে। কাশিমবাজার কুঠির পর এই বাংলোতেই জগৎশেঠ, উমিচাঁদ, ঘষেটি বেগম, ইয়ার লতিফ, মীর জাফর আলী খাঁ ইংরেজ বেনিয়া ওয়াটসনের সাথে বৈঠক করতেন। এই হান্ডিয়ালেই তৃতীয় মুঘল স¤্রাট আকবরের রাজত্বকালে প্রশাসনিক কার্যক্রমের সুবিধার্থে একজন সুবেদার ও একজন কাজী নিযুক্ত ছিলেন। শাহী সুবেদারের অধীনে ছিল মুঘলদের পাঁচ হাজার সেনা ও সেনানিবাস। এরও আগে পাঠান রাজত্বকালে সে সময়ের প্রমত্তা বড়াল তীরের এই এলাকা ব্যবসাবানিজ্যের বড় বন্দর ছিল। এখানে মুর্শিদাবাদ থেকে বজরায় ঢাকায় পৌঁছার আগে কিছুটা সময় হান্ডিয়ালে অবস্থান করতেন মুঘলরা।
হান্ডিয়ালের বাজারটি ছিল সমৃদ্ধ ঐতিহ্যবাহী- এর এক দালানে উঠে সব দালানের ছাদে ছাদে ঘুরে আসা যেত। কোম্পানির আমলে উন্নত বন্দর হান্ডিয়ালে গড়ে ওঠে রেশম ও তাঁতের কাপড়ের কেনাকাটার কুঠি। দিনে দিনে ব্যবসার প্রসার ঘটে। এই ব্যবসা এক সময় আরও প্রম্প্রসারিত হয়ে ভারতবর্ষে ছাড়িয়ে ইংল্যান্ডে পৌঁছে। ভারতবর্ষে যত রেশম উৎপন্ন হতো তার চার ভাগের তিনভাগই হান্ডিয়াল বাজারে পাওয়া যেত। এই হান্ডিয়াল থেকেই ব্রিটিশরা রেশম ও তুলা নিয়ে যেত স্বদেশে।
চাটমোহর ও সংলগ্ন হান্ডিয়াল এলাকায় বিশাল আয়তনের যে ৫০টি দীঘি আছে তা এক অপরুপ নিসর্গ। পূর্ণিমার রাতে এই দীঘির জল মৃদু ঢেউ খেলে প্রকৃতিতে ধ্রুপদী মাত্রা এনে দেয়। মনে হয় ওই দীঘির জলে চাঁদ নাচছে, তারা নাচছে। এমন নিসর্গ অবগাহনের মধ্যেই বাংলাসাহিত্যের নতুন ধারার সব্যসাচী লেখক প্রমথ নাথ চৌধুরী ১৮৬৮ সালে হরিপুর চৌধুরীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রমথ চৌধুরী সেই বাড়ী ধ্বংস হয়ে গেছে। তার ‘ঈশ্বরী পাটনী’ গল্পের সেই মন্ত্রশক্তির মন্দিরটিও রক্ষা করা হয়নি।
এ সবকিছু ছাপিয়ে হান্ডিয়ালের কিংবদন্তি ঘোষ পরিবার। এরা দই ও মিষ্টির এমন ধারা তৈরি করে যে কলকাতার সাহেব-বাবুরা হান্ডিয়ালের মিষ্টি ছাড়া কিছুই বুঝত না। কথিত আছে ইংরেজরা এই এলাকার মিষ্টির জন্য ৭০০ গোয়ালা পালন করত। তাদের কাজ ছিল নানা ধরনের মিষ্টান্ন বানিয়ে কলকাতায় পাঠানো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হান্ডিয়ালকে গুরুত্ব দিয়ে ‘বিশেষ পরগনা’ বানিয়ে ব্যবসাবানিজ্যসহ প্রশসনিক কাজ পরিচালনা করে। হান্ডিয়াল পরগনার সীমানা ছিল অনেক বিশাল। একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে যেতে নদী পথেই কয়েক দিন লাগত। অবশ্য ১২৯৪ বঙ্গাব্দের প্রলয়ঙ্কারী ভূমিকম্পে এই জনপদের অনেক স্থাপনা ধ্বংস হয়ে যায়। যার সাক্ষ্য মেলে এখনও। যে কোন স্থান খুঁজলে উঁকি দেয় ইট-পাথরের টুকরো। দীঘির জলে ডুব দিলেও পায়ে শক্ত কিছুর ছোঁয়া লাগে।
প্রায় তিন লাখ জনঅধ্যুষিত ৩০৫ দশমিক ৬৩ বর্গকিলোমিটার হান্ডিয়াল ও চাটমোহর শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে। ১৮টি স্কুল, হান্ডিয়াল কলেজসহ সাতটি ডিগ্রী কলেজ একটি মহিলা কলেজ, একটি টেকনিক্যাল ও বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট, যা চাটমোহরের শিক্ষা বিস্তারে করেছে আরও সমৃদ্ধ।