শফিউল আযম ঃ
দেশের উত্তরাঞ্চলের মাঠে মাঠে চোখ জুড়ানো থোকা থোকা হলুদ ফুলের সমারোহ। মাঠগুলো যেন হলুদ চাদরে মোড়ানো। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলে গেছে প্রকৃতির রুপ। প্রান্ত জুড়ে উঁকি দিচ্ছে সরিষা ফুলের দোল খাওয়া গাছ। সরিষার সবুজ গাছের হলুদ ফুল শিশির ভেজা শীতের সোনাঝরা রোদে ঝিকমিকিয়ে উঠছে। যেন প্রকৃতি সেজেছে হলুদবরণ সাজে। হলুদ রঙের আভার সাথে বাতাসে বইছে মৌ মৌ গন্ধ। মৌমাছি ব্যস্ত মধু সংগ্রহে। চোখ জুড়ানো এমন দৃশ্য দেখতে প্রকৃতিপ্রেমীরা সপরিবারে ভিড় করছেন মাঠে, তুলছেন ছবি।
বাংলাদেশে এখন চলছে শীতকাল। এই মওসুমে সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন মৌচাষিরা। সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌবাক্স স্থাপন করে ক্রিত্রিম পদ্ধতিতে মধু সংগ্রহ করছেন তারা। এর মাধ্যমে অনেকের বেকারত্ব দূর হয়েছে। বিদেশেও রফতানি হচ্ছে সরিষার মধু।
বর্তমানে সরিষা ফুলের মধু সর্বোত্তম মধু হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। মৌমাছিরা সরিষার ফুল থেকে যে মধু সংগ্রহ করে মৌচাক বানায় সেখানেই মেলে উন্নত মানের মধূ। দেশের প্রতিটি স্থানে সরিষার মওসুমে কাঠের বিশেষ ধরনের বাক্সে মৌমাছি পালান করে ক্ষেতে রাখা হয়। মৌমাছিরা সরিষার ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে ক্ষেতের মধ্যে পেতে রাখা বাক্সগুলোতে চাক বানায়। মৌচাক পূর্ণ হয়ে মধুতে ভরে গেলে মধু বের করে নেয়া হয়। বর্তমানে সরিষা ফুলের মধু দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশে রফতানি হচ্ছে।
চলনবিল শুধু মাছেই নয়; মধু উৎপাদনে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছে। বিদেশেও রফতানি হচ্ছে সরিষা ফুলের মধু। মৌমাছির গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে গোটা বিলাঞ্চল। এ অঞ্চলের ফসলের মাঠগুলোতে এখন সরষের হলুদ ফুলের সমারোহ। মাঠের পর মাঠ জুড়ে বিরাজ করছে থোকা থোকা হলুদ ফুলের দৃষ্টিনন্দন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। মধু উৎপাদনে চলনবিলে এক নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। আবহাওয়া অনুকুল থাকলে চলতি মওসুমে চলনবিল অঞ্চল থেকে প্রায় দুই হাজার দুই হাজার ৫০০ টন মধু আহরণের সম্ভাবনা রয়েছে বলে মৌচাষিরা আশা প্রকাশ করেছেন।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পাবনা জেলার বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ঈশ্বরদী, আটঘড়িয়া, সুজানগর চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, ফরিদপুর নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, তাড়াশ, সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া, চৌহালী, রায়গঞ্জ, শাহজাদপুরসহ ২৬টি উপজেলায় চলতি রবি মওসুমে প্রায় দেড় লাখ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন আগাম ও নাবী জাতের সরিষা চাষ হয়েছে। সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রতি হেক্টরে দুই টন হিসেবে প্রায় তিন লাখ টন এবং দুই থেকে আড়াই হাজার টন মধু উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। বনপাড়া-হাটিকুমরুল যমুনা সেতু সংযোগ মহাসড়কের দু’ধারে মাঠের পর মাঠ দৃষ্টিনন্দন মনোমুগ্ধকর থোকা থোকা হলুদ ফুলের চাদর বিছানো। সেই হলুদ ছুঁয়েছে দিগন্তরেখায়। চলতি মওসুমে সরষের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে কৃষি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
চলনবিল অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী কলমগ্রামের কৃষক রমজান আলী জানান, এক বিঘা (৩৩ শতাংশ) জমিতে সরিষা চাষ করতে খরচ হয় এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। ভালো ফলন হলে প্রতি বিঘা ছয় থেকে সাত মন সরিষা উৎপাদন হয়। প্রতি মন সরিষার বাজার মূল্য দুই হাজার থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা। অন্যান্য ফসল আবাদ করে প্রতি বিঘায় যে পরিমান লাভ হয় তার চেয়ে ওই পরিমান জমিতে সরষে চাষ করে দ্বিগুণ লাভ করা যায়। এ অঞ্চলে সরষের আবাদ বৃদ্ধির সাথে সাথে বেড়েছে মওসুমি মৌচাষিদের তৎপরতা। সরষে যেমন দিচ্ছে তেল, সাথে দিচ্ছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এছাড়া সরিষার ফুল ও পাতা ঝরে তৈরি হয় জৈবসার। ফলে কৃষকেরা এখন ধান ও অন্যান্য ফসলের পাশাপাশি সরিষা চাষের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছে। পাবনার হান্ডিয়াল এলাকার কৃষক আলেক দেওয়ান জানন, তিনি পাঁচ একর জমিতে সরিষা আবাদ করে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছেন। ছয় বছর ধরে সরষে চাষ করে তিনি প্রতি মওসুমে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা লাভ করেছেন। চলতি মওসুমে আরো বেশি লাভের আশা করছেন বলে তিনি জানিয়েছেন।
ইউরোপিয়ান হাইব্রীড এপিস মেলিফেরা মৌমাছির মৌ মৌ গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠেছে গোটা বিলাঞ্চল। ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি উড়ে গিয়ে সরিষা ফুলে বসছে। কিছুক্ষণ পর পর মধু নিয়ে উড়ে এসে মৌমাছির দল ফিরছে মৌবাক্্ের। চলতি মওসুমে যদি আবহাওয়া অনুকুল থাকে তাহলে চলনবিল থেকে দুই থেকে আড়াই হাজার টন মধু আহরণের সম্ভাবনা রয়েছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রতি কেজি সর্বনি¤œ ২৫০ টাকা হিসেবে ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা। এমনটিই আশা করছেন মৌচাষিরা। প্রায় এক সপ্তাহ আগে বগুড়া, যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, সাতক্ষীরা, পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় সাত শতাধিক প্রশিক্ষিত মৌখামারি চলনবিলে অস্থায়ী আবাস গেড়েছেন। মৌচাষিরা সরিষা ক্ষেতের আলে ৪৫ থেকে ৫৫ হাজার মৌবাক্স বসিয়েছেন। প্রতি বছর নভেম্বর থেকে মধু সংগ্রহ করা হলেও এবার দীর্ঘ বণ্যায় ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত সরষে ফুলের মধু আহরণ চলে। এ সময়ে গড়ে একেকজন মৌচাষি গড়ে দুই থেকে আড়াই টন মধু আহরণ করতে পারেন।
উত্তরবঙ্গ মৌচাষি সমিতির সভাপতি পাবনার চাটমোহরের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম জানান, গত বছরের চেয়ে এবার প্রায় দ্বিগুন মৌবাক্্র নিয়ে হাজির হয়েছেন মৌচাষিরা। চলনবিল শুধু মাছের বিলই নয়; এখন মধু উৎপাদনের বিল হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। মধু উৎপাদনে চলনবিল এক নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত উন্মোচন করেছে। প্রাকৃতিক উপায়ে মধু সংগ্রহের ফলে শুধু মৌচাষিরাই লাভবান হচ্ছেন তাই নয়। মৌমাছির বিচরণে সঠিকভাবে সরিষা ফুলে পরাগায়ন ঘটছে। তাতে সরষের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে গেছে অনেক। এতে লাভবান হচ্ছেন কৃষকরা। শুধু তাই নয় পরিবেশবিদরা বলছেন, ক্ষেতে কীটনাশক ব্যবহার কম হওয়ায় উপকৃত হচ্ছে পরিবেশ। মৌমাছি শুধু মধুই সংগ্রহ করে না, ফসলের জন্য ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ মেরে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষকদের সহায়তা করে থাকে।
বর্তমানে প্রতি সপ্তাহে মধু সংগ্রহের পরিমান প্রায় এক লাখ কেজি। প্রতি কেজি মধু ২০০ টাকা দরে অগ্রিম বিক্রি হচ্ছে মাঠ থেকে। এ অঞ্চলে উৎপাদিত ভেজালমুক্ত মধুর গুণগত মান খুবই ভালো। এ জন্য ভারতের ডাবর কোম্পানী, ঢাকার প্রাণ, স্কয়ার, এপি, এসিআইসহ ব্যান্ড প্রসাধনী কোম্পানীর এজেন্টরা চলনবিলের মাঠ থেকে অপরিশোধিত মধু অগ্রিম কেনা শুরু করেছে। সুন্দরবনের মধুচাষিরা চলনবিলে মধু সংগ্রহ করতে এসেছেন। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে এখানে মধু সংগ্রহ পুরোদমে শুরু হয়েছে।
পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ড. তাহমিনা হক জানান, অতীত কাল থেকে মধু বহু রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। মধু পরিপাকে সহায়তা করে, ক্ষুধা বাড়ায়, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি, সর্দি, কাশি, জ্বর, হাপানি, হৃদরোগ, পুরনো আমাশয়, দাঁত, ত্বক, পেটের পীড়াসহ নানা জটিল রোগ নিরাময় করে থাকে। মধুতে বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান ও ভেষজ গুণ রয়েছে। মধুর উচ্চমাত্রার ফ্রুক্টোজ ও গ্লুকোজ যা যকৃতে গ্রাইকোজেনের মজুত গড়ে তুলতে সাহায্য করে। মধুতে রয়েছে ফলশর্করা ৩৮.২ ভাগ, গ্লুকোজ ৩১.৩ ভাগ, মালটোস ৭.১ ভাগ, সুক্রোজ ১.৩ ভাগ, পানি ১৭.২ ভাগ, উচ্চ চিনি ১.৫ ভাগ, ছাই ০.২ ভাগ, খনিজ পদার্থ আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফসফেট, সোডিয়াম ক্লোরিন, পটাশিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম রয়েছে ৩.২ ভাগ। এছাড়া মধু ভালো শক্তি প্রদায়ী খাদ্য।
খুলনা থেকে চলনবিলের কলম এলাকায় মধু সংগ্রহ করতে আসা নাছির উদ্দিন বলেন, প্রায় পাঁচ বছর ধরে সে মধু আহরণ করছে। মাত্র কয়েক দিন হলো এখানে এসেছি। মনে হচ্ছে গত বারের চেয়ে অনেক বেশি মধু সংগ্রহ হবে। গত বছর দুই টন মধু আহরণ করেছিলেন, এবার আবহাওয়া ভালো থাকলে তিন টনের বেশি মধু সংগ্রহ করতে পারবেন। মৌচাষিরা জানান, বছরের সাত মাস মধু পাওয়া যায়। সরিষার পর লিচু, আম, ধনিয়া, তিলসহ বিভিন্ন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করা হয়।