শফিউল আযম,বেড়া (পাবনা) সংবাদদাতা ঃ
বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা- (ডেল্টা প্লান) ২১০০ অংশ-১ এর আওতায় সিরাজগঞ্জ পাউবো’র তত্বাবধানে শাহজাদপুরে প্রায় সাত কোটি টাকা ব্যয়ে হুড়াসাগর শাখা-১ নদীর ১০ কিলোমিটার পূনঃখনন কাজ চলছে। এ সময় নদী পূনঃখনন করায় উপজেলার ১২টি মৌজার প্রায় এক হাজার একর (তিন হাজার বিঘা) জমির থোড় ও ছড়া বের হওয়া ধান গাছ কৃষকেরা কেটে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এর ফলে তারা প্রায় ২৫ হাজার টন ধান পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৪২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অনেক কৃষকই মহাজনের কাছ থেকে দাদনে টাকা নিয়ে ধান আবাদ করেছিলেন। এখন দাদনের টাকা কিভাবে পরিশোধ করবেন এ চিন্তায় তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
জানা যায়, শাহজাদপুরের হাটপাচিলের পূর্বপাড়ার আধা কিলোমিটার দুরে যমুনা নদী থেকে হুড়াসাগর শাখা নদী উৎপত্তি হয়ে গোপালপুর, ভাঙ্গা, সৈয়দপুর, মলকান্দিরসহ প্রায় ৩০টি গ্রামের মধ্য দিয়ে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে নগরঢালায় করতোয়া নদীতে মিলিত হয়েছে। স্বাধীনতার পর পানি উন্নয়ন বোর্ড হাটপাচিলে বণ্যানিয়ন্ত্র বাঁধ নির্মাণ করায় হুড়াসাগর নদীর প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। পরে পলি ও বালি জমে ভরাট হয়ে নদী ফসলী জমিতে পরিনত হয়েছে। ডিএস রেকর্ডে হুড়াসগর শাখা নদী খাস খতিয়ান ভূক্ত। নদী পাড়ের স্থানীয় কৃষকরা জমি পত্তনি নেয়ায় এসএ এবং আরএস রেকর্ড তাদের নামে হয়েছে। প্রায় তিন যুগ ধরে এই জমি তারা ভোগ দখল করে আসছেন। এদিকে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বিভাগ দাবি করছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড ১৯৮৮-৮৯ সালে হুড়াসাগর শাখা নদী প্রস্তে ১০০ ফুট ও দৈর্ঘ্যে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত জমি অধিগ্রহন করে সেই সময় স্থানীয় কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। তবে কি পরিমান জমি অধিগ্রহন করা হয়েছে, সে তথ্য পাউবো বিভাগ দিতে পারেনি।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ অংশ-১ এর আওতায় দেশের ৬৪ জেলার ছোট নদী, খাল, জলাশয় পূনঃখনন করে পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৎস্য চাষ, ভূমি পূনরুদ্ধার ও বনায়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। এই প্রকল্পের আওতায় সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বিভাগ প্রায় সাত কোটি টাকা ব্যয়ে শাহজাদপুর উপজেলার করতোয়া নদীর পূর্বপাড় নগরঢালা থেকে কৈজুরির হাটপাচিল পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার হুড়াসাগর শাখা নদী পূনঃখনন কাজ করছে। প্রায় ১২ মিটার (৩৬ ফুট) প্রস্ত ও দুই মিটার গভীর করে নদী পূনঃখনন করা হচ্ছে। খননকৃত মাটি অপরিকল্পিতভাবে দুই পাড়ে স্তুপ করে রাখা হয়েছে। বৃষ্টি ও বর্ষায় মাটি ধসে খালের গভীরতা কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পূর্ব ঘোষনা ছাড়াই সিরাজগঞ্জ পাউবো এই নদী পূনঃখনন কাজ শুরু করায় সৈয়দপুর, মলকান্দি, গোপালপুরসহ ১২টি মৌজার প্রায় এক হাজার একর জমির থোর ও ছড়া বের হওয়া ধান গাছ কাটা পড়ছে। এতে কৃষকরা ফসল হারিয়ে বিলাপ করছেন। বর্তমানে ছোটমারাচপুর থেকে দুই ভাগে নদী খনন করে পূর্বে গোপালপুর এবং পশ্চিমে নগরঢালার দিকে যাচ্ছে। সিরাজগঞ্জের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্কেভেটর মেশিনের সাহায্যে পূনঃখনন করায় দিন মজুররা কাজের সুযোগ পাচ্ছে না। এলাকার কৃষকরা বাধ্য হয়ে ধান গাছ কেটে নিয়ে গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করছেন। রক্তে ঘামে ফলানো ফসল হারিয়ে শত শত কৃষক পথে বসেছেন। অনেকেই মহাজনের ঋণের টাকা কি ভাবে পরিশোধ করবেন ? এ চিন্তায় তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
হুড়াসাগর শাখা নদী পূনঃখনন এলাকা শাহজাদপুরের জালালপুর ইউনিয়নের পূর্বকৈজুরির গোপালপুর গ্রামের বাসিন্দা ভূমিহীন অখিল মন্ডলের সাথে কথা হয়। সে একটি বোরো স্কীমের মালিক। তার স্কীমে ৯ বিঘা জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে। তিনি নিজে ১০ হাজার টাকায় এক বিঘা জমি লীজ নিয়ে বোরোর আবাদ করেছেন। এ পর্যন্ত এক বিঘা জমিতে লীজসহ তার খরচ হয়েছে প্রায় ২০ হাজার টাকা। আর মাত্র এক মাস পরেই ধান ঘরে তুলতে পারতেন। কিন্তু নদী পূনঃখননে সে জমির ধান কাটা পড়েছে। স্কীমের অন্যান্য কৃষকরা ক্ষেতের ধান কাটা পড়ায় সেচের টাকা পরিশোধ করছে না। এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে। তিনি দোকান থেকে বাঁকীতে ডিজেল তেল কিনে স্কীমের জমিতে পানি সেচ দিয়েছেন। দোকান মালিকের টাকা কিভাবে পরিশোধ করবেন ? এ চিন্তা তাকে সর্বক্ষণ তারা করে ফিরছে।
একই গ্রামের শামীমের দুই বিঘা, হাজী মোঃ ফজর আলী মোল্লার দুই বিঘা, সাবেক মেম্বর গফুরের সাড়ে তিন বিঘা, সরোয়ারের আড়াই বিঘা, জেন্দার আলীর চার বিঘা, ইউনুস আলীর তিন বিঘা, শহীদ আলীর এক বিঘাসহ অনেকের জমি পূনঃখননের আওতায় পড়েছে। শামীম বলেন, পানি উন্নয়ন বিভাগ জমি অধিগ্রহন করেছে বলে দাবি করছে, তাবে এ বিষয়টি তার কাছে কোন তথ্য নেই। তার বাবা দলিল মূলে জমি খরিদ করে ভোগদখল করে আসছে। পূর্ব ঘোষনা ছাড়া হুট করে নদী পূনঃখনন কাজ শুরু করায় শত শত কৃষক জমি ও ফসল হারিয়ে এখন পথে বসেছে। তাদের এক মাস সময় দিলে কষ্টে ফলানো ফসল ঘরে তুলতে পারতেন। কিন্তু পাউবো কতৃপক্ষ সে সুযোগ তাদের দেয়া হচ্ছে না।
পূর্বকৈজুরি গ্রামের বাসিন্দা রহম প্রামানিকের পরিবারের অবস্থা সবচেয়ে বেশি করুন। এক সময়ের স্বচ্ছল এই পরিবারটি ধারদেনা ও জমি বিক্রি করে ছেলে শাহ আলমকে দালালের মাধ্যমে মালয়েশিয়া পাঠিয়েছিলেন। মালয়েশিয়ায় ধরা পরে সর্বস্ব হারিয়ে শাহ আলম শুন্য হাতে দেশে ফিরে আসায় পরিবারটির ভাগ্যে নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়। স্থানীয় মহাজনের কাছ থেকে দাদনে টাকা নিয়ে ছয় বিঘা জমিতে ধান আবাদ করেছিলেন। এই জমির ধানেই তার সারা বছরের সংসার খরচ চলে। হুড়াসাগর শাখা নদী পূনঃখননে জমি ও ধান হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। কি ভাবে সংসার চলবে, কি করে দাদনের ঋণে টাকা পরিশোধ করবেন এ চিন্তায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোঃ রফিকুল ইসলাম (কবি) মোবাইল ফোনে এ প্রতিনিধিকে বলেন, ডিএস রেকর্ডে হুড়াসাগর শাখা নদী খাস খতিয়ানভূক্ত আছে। পরে এসএ এবং আরএস রেকর্ডে এসে ব্যক্তি মালিকানাধীন হয়েছে। তিনি প্রশ্নে করেন, খাস খতিয়ানভূক্ত জমি কি করে ব্যক্তি মালিকানাধীন হয় ? ব্যক্তি মালিকানাধীন কোন জমি খনন করা হচ্ছে না। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ১৯৮৮-৮৯ সালে ১০০ ফুট প্রস্তে এবং ১০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যে হুড়াসাগর শাখা নদীর জমি অধিগ্রহন করা হয়। সেই অধিগ্রহনকৃত জমিতেই পূনঃখনন কাজ চলছে। কি পরিমান জমি অধিগ্রহন করা হয়েছিল, সে তথ্য তিনি দিতে পারেননি।