শফিউল আযম ঃ
পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের বাথানের দিগন্ত বিস্তীর্ণ ভূমিতে উন্নতজাতের প্রায় লক্ষাধিক গরু বিচরণ করছে। এসব গরুর আয়ের ওপর নির্ভরশীল প্রায় দুই লাখ পরিবার। বাথান থেকে প্রতিদিন সংগ্রহ করা হচ্ছে প্রায় এক লাখ লিটার খাঁটি তরল দুধ। এই দুধ সরবরাহ করা হয় সরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটায়। বাঘাবাড়ী মিল্কভিটাসহ বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দুধ সংগ্রহের পরিমান কমিয়ে দেয়ায় গোখামারী ও কৃষকদের উৎপাদিত দুধ স্থানীয় হাট-বাজারে লোকসান দিয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে অব্যাহত লোকসানের মুখে পড়ে অনেকেই খামার বন্ধ করে অন্য পেশা চলে যাচ্ছেন।
শতাব্দীর প্রাচীন কাল থেকে পাবনা-সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের গোখামারী ও কৃষকরা উন্নতজাতের পাক-ভারতের জার্সি, ফ্রিজিয়ান, এফএস, শাহিওয়াল, সিন্ধি, হরিয়ানা ও মুলতানি গরু লালন-পালন করে আসছেন। এ অঞ্চলের গোসম্পদের ভবিষ্যৎ এবং গোসম্পদকে অর্থকরী সম্পদে রুপ দিতে স্বাধীনতার পর বাঘাবাড়ীতে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী সমবায়ী প্রতিষ্ঠান বাঘাবাড়ী মিল্কভিটা করখানা স্থাপন করা হয়। স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তির দৌরাত্বে মিল্কভিটার আওতাভূক্ত বিস্তীর্ণ গোচারন ভূমি সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা গোচারণ ভূমির প্রায় ৫৫০ একর জমি জাল দলিল ও পত্তনি নিয়ে আরএস রেকর্ডের মাধ্যমে জোড়পূর্বক ভোগদখল করে নিয়েছে। ওই জমিতে তারা ইরি-বোরো ধানসহ বিভিন্ন ফসল আবাদ করে আসছে। বর্তমানে মিল্কভিটার নিয়ন্ত্রনাধীন মাত্র ৮৫০ একর জমি রয়েছে, সেই জমিও যথাযথ ব্যবহার করা সম্বব হচ্ছে না। ফলে বাথানে গরুর বিচরণ ও দুধ উৎপাদন অনেক কমেছে। বিগত বছরগুলোতে বাথানে প্রতিদিন গড়ে দেড় থেকে দুই লাখ লিটার দুধ উৎপাদন হতো। বর্তমানে দুধের উৎপাদন কমে দাঁড়িয়েছে এক লাখ লিটার।
জানা যায়, সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ী-নিমাইচরা বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধের রাউতরার কাছে অস্থায়ীভাবে নির্মিত বিকল্প রিং বাঁধটি প্রতিবছর আগাম বন্যায় ভেঙ্গে তলিয়ে যায় গোচারন ভূমি। অথচ আধা কিলোমিটার স্থায়ী বাঁধ নির্মান করা হলে গবাদি-পশু কমপক্ষে নয় থেকে ১০ মাস বাথানে সবুজ ঘাস খেতে পারতো। খামারীদের লাখ লাখ টাকা সাশ্রয় হতো। গো-খাদ্যে খড়, ভুসি, খৈল, লালির উচ্চমূল্যের কারনে খামারীরা আর পুষিয়ে উঠতে পারছে না। অনেক খামারী অভিযোগ তুলে বলেছেন, মিল্কভিটা লাভজনক প্রতিষ্ঠানে দাঁড়িয়েছে। অথচ খামারীদের এখন তেমন লাভ হচ্ছে না। খামারীরা দীর্ঘদিন ধরে দুধের মূল্য পাঁচ থেকে সাত টাকা বৃদ্ধির দাবি করে আসছেন। সরকারি বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দুধের দাম না বাড়িয়ে দুধ সংগ্রহের পরিমান কমিয়ে দিয়েছে বলে খামারীরা অভিযোগ করেছেন। মানবসম্পদ উন্নয়নের মতো গোসম্পদ উন্নয়নে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে সেদিন আর বেশি দুরে নেই, যেদিন এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী গোসম্পদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।
খামারীরা জানান, সরকারী দুগ্ধ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকারী সমবায়ী প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটাসহ বেসরকারী দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খামারীদের কাছ থেকে চার দশমিক শুন্য স্ট্যার্ন্ডাড ননীযুক্ত তরল দুধ প্রতি লিটার ৪৩ টাকা দরে কিনে সেই দুধ থেকে ননী বেড় করে নিচ্ছে। পরে তিন দশমিক ৫০ স্ট্যান্ডার্ড ননীযুক্ত তরল দুধ প্যকেটজাত করে প্রতি লিটার ৬৫ টাকা দরে বিক্রি করছে। তবে ভোক্তা পর্যায়ে এ দুধ বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকা লিটার। প্রতি লিটার দুধ থেকে শুন্য দশমিক ৫০ স্ট্যান্ডার্ড ননী তুলে ঘি তৈরি করা হচ্ছে। এতে প্রতি লিটার দুধে লাভ হচ্ছে ২২ টাকা। এছাড়া এক লিটার দুধ থেকে ৪০ টাকার প্রায় ৪০ গ্রাম ঘি উৎপাদিত হচ্ছে। সব মিলে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি লিটার দুধে আয় করছে ১০৫ টাকা। এতে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি লিটার দুধে প্রায় ৬২ টাকা লাভ করছে। অপরদিকে অব্যাহত লোকসানের মুখে কৃষক ও খামারীরা এ পেশাকে অলাভজনক মনে করে অনেকেই খামার বন্ধ করে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। খামারীরা দীর্ঘদিন ধরে প্রতি লিটার দুধের দাম পাঁচ থেকে সাত টাকা বৃদ্ধির দাবি করে আসছে। তাদের সে দাবি পুরন হচ্ছে না।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, স্বাধীনতার আগে চলনবিল অঞ্চলের বেড়া, সাঁথিয়া, ফরিদপুর, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর, উল্লাপাড়া ও শাহজাদপুর উপজেলায় ৪০০টি বাথানে প্রায় পাঁচ হাজার একর গোচারন ভূমি ছিল্। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি নানা কৌশলে জাল দলিল ও ভূয়া পত্তনির কাগজপত্র তৈরি করে এসএ ও আরএস রেকর্ড নিজেদের নামে করে গোচারন ভূমি জোড়পূর্ব ভোগদখল করছে। শাহজাদপুর উপজেলা ভুমি অফিস সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে গোচারন ভূমির পরিমান প্রায় এক হাজার ৪০০ একর। এরমধ্যে ফরিদপুর উপজেলায় প্রায় ১০০ একর খাস, শাহজাদপুর উপজেলায় সমর্পিত খাস ৭১২ দশমিক ৬৮ ও অর্পিত ৫৭৯ দশমিক ১৬ একর গোচারণ ভূমি রয়েছে।
মিল্কভিটার ম্যানেজার সোসাইটি জানান, মাত্র ৮৫০ একর জমি তাদের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। অবশিষ্ঠ ৫৫০ একর জমি ভূয়া দলিল ও পত্তনির মাধ্যমে দখল করে নিয়েছে একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি। এছাড়া বাথানের রাউতগাড়ি, রামকান্তপুর ও হান্নি মৌজায় প্রায় ১০০ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ‘রবীন্দ্র বিশ^বিদ্যালয় বাংলাদেশ’। তিনি জানান, ব্যক্তি মালিকানাধীন গোচারণ ভূমি অনেকেই বোরো ধানসহ বিভিন্ন ফসল আবাদে ব্যবহার করছেন। যে কারনে গোচারণ ভূমি আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। ফলে বিশাল এ গোসম্পদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা অনিশ্চয়তা।
পৌষ মাস থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস ( ছয় মাস) পর্যন্ত গবাদিপশু বাথাণ এলাকায় অবস্থান করে। বানের পানি গোচারণ ভূমি থেকে নেমে যাওয়ার পর আবাদকৃত ঘাস খাওয়ার উপযোগী হলেই গবাদিপশু বাথানে নেয়া হয়। বাথান এলাকার অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে বাঁশের ঘেরা দিয়ে গরুগুলো রাখা হয়। তবে বকনা, ও থারি, ষাঁড় এবং বাছুরগুলোর জন্য পাশাপাশি রয়েছে আলাদা ঘেরার ব্যবস্থা। বিস্তীর্ণ গোচারন ভূমিতে চরে বেড়ানোর পর বিকেলে এরা ঘেরায় ফিরে আসে। গবাদিপশুর খৈল-ভূসি ও রাখালদের থাকার জন্য রয়েছে খড়ের তৈরি ঘর। প্রায় ছয় মাস রাখলদের থাকতে হয় এখানে। গোচারণ ভূমি বানের পানিতে তলিয়ে গেলে গবাদিপশু নিয়ে আসা হয় গোশালায়।
গবাদিপশুর মালিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, একক মালিকানায় বাথানের সংখ্যা নেই বললেই চলে। পাঁচ থেকে ১৫ জন মিলে একত্রে একটি বাথানে আয়তন ভেদে ২০০ থেকে ৭০০ গরু রাখেন। এসব খামার মালিকদের প্রায় প্রতিদিনই একবার করে বাথানে যেতে হয় খোঁজখবর নিতে। তবে তাদের বেশিরভাগ সময় কাটে খৈল-ভূসি-লালি সরবরাহ দুধের দাম ইত্যাদি সংগ্রহ করে। খামার মালিকদের নিয়োজিত রাখালরা সার্বক্ষনিক বাথানে অবস্থান করে। পুরোপুরি এদের ওপরই নির্ভর করতে হয় গরুর মালিকদের।
রাউতরা বাথানে একাধিক খামারীর সাথে কথা বলে জানা যায়, রাখালরা সাধারনত বছর চুক্তিতে রাখালি করে থাকে। যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা এবং বয়সভেদে বছরে ৩৬ থেকে ৬০ হাজার টাকা করে প্রতি রাখালকে দেয়া হয়। খাওয়া-দাওয়া, লুঙ্গি ও গামছা খামার মালিকরাই সরবরাহ করে থাকেন। খামার মালিকদের দেয়া নানা নামে গরুর নাম রাখা হয়। রানী, লক্ষি, ময়না, পার্বতী, নিশানী ইত্যাদি নামে ডাকলেই গরুগুলো ডাকে সাড়া দেয়। মাঠে চরে বেড়ানো ও দোহন কাজের সময় আলাদা করা জন্য এসব নাম ধরে তাদের ডাকা হয়। খামার মালিক সাইফুল ইসলাম আজাদ জানান, প্রথম বাচ্চা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাভীকে নাম দরে কয়েকদিন ডাকলে বাছুরটিও ওই নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। বর্তমানে বাথানে প্রতিদিন সকাল বিকাল প্রায় এক লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ হয়। এই দুধ বাঘাবাড়ী মিল্কভিটায় সরবরাহ করা হতো। প্রতিদিন মিল্কভিটার তরল দুধ সংগ্রহের পরিমান ছিল দেড় লাখ লিটার। দীর্ঘদিন ধরে যান্ত্রিক ক্রটির কারণে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৯০ হাজার থেকে এক লাখ লিটারে। এতে মিল্কভিটার আওতাভূক্ত প্রাথমিক দুগ্ধ সমবায় সমিতির সদস্যরা উৎপাদিত দুধ লোকসান দিয়ে স্থানীয় হাট-বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। অব্যাহত লোকসানের মুখে অনেকেই খামার ব্যবসা বন্ধ করে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন।
খামারী রজব আলী শেখ জানান, একটা গাভীর পেছনে গোখাদ্য বাবদ প্রতিদিন ২৫০ টাকার বেশি খরচ হচ্ছে। বছরে একটি গাভীর পেছনে গোখাদ্য বাবদ খরচ ৯০ হাজার টাকা, গোহাল ঘর তৈরি ও মেরামত বাবদ ১০ হাজার টাকা, চিকিৎসা বাবদ দুই হাজার টাকা এবং রাখাল বাবদ ৩০ হাজার টাকাসহ সব মিলে প্রায় এক লাখ ৩২ হাজার টাকা ব্যয় হয়। তারা আরো জানান, একটি গাভী বছরে সাত মাস দুধ, গোবর এবং একটি বাছুর দেয়। গড়ে প্রতিদিন ১০ লিটার দুধ দিলে সাত মাসে ৯০ হাজার ৩০০ টাকার দুধ, বছরে পাঁচ হাজার টাকার গোবর ও ২১ হাজার টাকা মূল্যের একটি বাছু দেয়। সব মিলে এক লাখ ১৬ হাজার ৩০০ টাকা পাওয়া যায়। বছর শেষে প্রায় ১৫ হাজার ৭০০ টাকা লোকসান গুনতে হয়।
বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারি প্রতিষ্ঠান প্রাণ ডেইরির সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ীতে অবস্থিত আঞ্চলিক দুধ সংগ্রহ কেন্দ্রে সূত্রে জানা যায়, তাদের রংপুর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা অঞ্চল থেকে প্রতিদিন দেড় লাখ লিটার তরল দুধ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিদ্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু চাহিদার তুলায় সরবরাহ কম থাকায় প্রতিদিন দুধ সংগ্রহ করা হচ্ছে মাত্র এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার লিটার।