মোবাইল অপারেটররা রাষ্ট্র ও জননিরাপত্তার হুমকি বাড়াচ্ছে

0
618

মোবাইল ফোন অপারেটরদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত উদ্বেগজনক কিছু অভিযোগ উঠেছে। টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি বলছে, সরকারের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে অপারেটরগুলো এমন কিছু করছে, যা রাষ্ট্র ও জননিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। অপারেটরদের কর্মকাণ্ডে অনেক গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন—তাঁদের মধ্যে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহেমদ পলক এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. শহিদুল ইসলামও রয়েছেন। তাঁদের ‘প্রিমিয়াম’ মোবাইল ফোন নম্বর অন্য গ্রাহককে দিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। জানা যায়, এসব বিষয়ে বিটিআরসি ব্যাখ্যা চাইলেও সংশ্লিষ্ট অপারেটররা গড়িমসি করেছে, নিয়েছে মিথ্যারও আশ্রয়। বিটিআরসির ভাষায়—এ ক্ষেত্রে ‘ধৃষ্টতা প্রদর্শন’ এবং প্রতিমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে ‘শিষ্টাচারবহির্ভূত’ মন্তব্য করা হয়েছে। এসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট অপারেটরদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন-২০০১ (সংশোধিত ২০১০)-এর ধারা-৬৫ অনুযায়ী প্রশাসনিক জরিমানা আরোপ ও অন্যান্য আইনি কার্যক্রম সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিটিআরসি। বাংলালিংক অনিয়মে তাদের ১২ জন প্রতিনিধির যোগসাজশ থাকার কথা স্বীকার করার পর গত ২৭ মার্চ তাদের নতুন করে চিঠি দেওয়া হয় বলে কালের কণ্ঠকে জানিয়েছেন বিটিআরসির সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিস বিভাগের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজিজুর রহমান সিদ্দিকী।

টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা সূত্রে জানা যায়, প্রতিমন্ত্রীর নম্বর ‘ডুয়াল ক্লেইম’ পদ্ধতিতে আরেক গ্রাহককে দেওয়া হয়, তারপর বদলে (পোর্টিং) ফেলা হয় অপারেটর। অবৈধভাবে চালু করে দেওয়া হয়েছে বায়োমেট্রিকস ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে পুনর্নিবন্ধন না করার কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি সিম। সিম নিবন্ধনের তথ্য সেন্ট্রাল বায়োমেট্রিকস ভেরিফিকেশন মনিটরিং প্ল্যাটফর্মে (সিবিভিএমপি) দেওয়ার যে নির্দেশনা আছে, তাও লঙ্ঘন করা হয়েছে।

গত ৪ মার্চ অনুষ্ঠিত বিটিআরসির ২২৪তম সভার কার্যপত্রে এসব অভিযোগ সবিস্তারে উল্লেখ করে বলা হয়, ‘টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা-৭৩-এর উপধারা-১(ক) অনুযায়ী উক্ত লাইসেন্সিং গাইডলাইনের শর্ত লঙ্ঘন করা একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।’ কার্যপত্রে ‘রাষ্ট্রীয় এবং জননিরাপত্তা বিধানের স্বার্থে এ ধরনের কর্মকাণ্ড রোধে উক্ত অপরাধ আমলে নিয়ে’ রবি ও বাংলালিংকের টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা-৭৩-এর উপধারা-২ অনুসারে জরিমানা করার প্রস্তাব করা হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, বিটিআরসির সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগ অপরাধের ধরন ও ক্ষতির পরিমাণ বিবেচনা শেষে প্রশাসনিক জরিমানার পরিমাণ নির্ধারণ করবে। এরপর লিগ্যাল ও লাইসেন্সিং বিভাগ জরিমানা আদায়সহ পরবর্তী আইনি কার্যক্রম সম্পন্ন করতে অপারেটর দুটিকে চিঠি দেবে।

জানা যায়, গ্রাহকদের অভিযোগ পেয়ে বিটিআরসি গত ২৭ জানুয়ারি রবির কাছে ই-মেইলে তিনটি মোবাইল ফোন নম্বরের নিবন্ধন ও বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চায়। রবি ওই দিনই বিটিআরসিকে ই-মেইলে এ বিষয়ে তথ্য জানালেও দুটি নম্বরের বিষয়ে ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দেয়। এই দুটি নম্বরের একটি বায়োমেট্রিকস ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে নিবন্ধন না করার কারণে ২০১৬ সালে বিটিআরসির নির্দেশনায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট গ্রাহক আবেদন করলে রবি তদন্ত না করেই নম্বরটি সচল করে দেয়। বিটিআরসির নির্দেশনা হচ্ছে, বায়োমেট্রিকস ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে নিবন্ধন না হওয়া সিম বন্ধ হলে সংশ্লিষ্ট গ্রাহক যদি ৫৪০ দিনের মধ্যে সঠিকভাবে নিবন্ধন সম্পন্ন করেন তাঁকে ওই সিম সচল করে দেওয়া যাবে। কিন্তু এটি সচল করে দেওয়া হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ সময় পর—৯৩২ দিনের মাথায়। এ ছাড়া ওই সিমের নিবন্ধনের তথ্য সিবিভিএমপি-এ দেওয়া হয়নি। অন্য নম্বরটির বিষয়ে রবি জানায়, নম্বরটির নিবন্ধন নেই এবং সে কারণে সচল নয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের পাঠানো স্ক্রিনশটে দেখা যায় ২৭ জানুয়ারি নম্বরটি সচল ছিল। এই ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য কেন দেওয়া হলো তা জানতে চাইলে গত ৩১ জানুয়ারি রবি আবারও যে জবাব দেয় তাতে তাদের আগের জবাব ভুল প্রমাণিত হয়। আগের জবাবে সিমটি সচল নয় জানানো হলেও দ্বিতীয় জবাবে নিবন্ধন বিষয়ে কোনো তথ্য ছাড়াই জানানো হয় সিমটি সচল। এ বিষয়ে বিটিআরসির ভাষ্য : ‘অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে এই জবাবের মাধ্যমেও তারা পুনরায় মিথ্যা তথ্য প্রদান করে, যা দুঃখজনক।’

বাংলালিংকের বিষয়ে অভিযোগ হচ্ছে—তারা প্রতিমন্ত্রী পলক ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শহিদুল ইসলামসহ বিভিন্ন গ্রাহকের প্রিমিয়াম নম্বর ‘ডুয়াল ক্লেইম’ পদ্ধতিতে তুলে নিয়ে গ্রামীণফোনে স্থানান্তর করে। এ বিষয়ে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে পাঁচ মাস আগে বিটিআরসির কাছে অভিযোগ করা হয়। বিটিআরসি তাত্ক্ষণিক এর ব্যাখ্যা চাইলে বাংলালিংক প্রথমে জানায়, বিষয়টি সত্য এবং এ বিষয়ে অধিকতর তদন্ত হচ্ছে। এরপর এ বিষয়ে সম্পূর্ণ প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও সর্বশেষ নির্ধারিত ২৯ জানুয়ারি তা জমা না দেওয়ার ধৃষ্টতা দেখায় বলে বিটিআরসির ২২৪তম সভার কার্যপত্রে উল্লেখ করা হয়। এতে আরো বলা হয়, এরপর ৩১ জানুয়ারি যে প্রতিবেদন জমা দেয় তা অসম্পূর্ণ এবং ওই ঘটনা সংঘটনে বাংলালিংক নিজেদের সম্পৃক্ততা এড়িয়ে বাইরের দুজন প্রতারককে অভিযুক্ত করে প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করে। এর মধ্যে একজনের নাম মো. আব্দুল মোতালেব (জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর- ৭২১৪৭৬৭১০৭৯৩১)।

বিটিআরসির সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, প্রতিবেদনে বাংলালিংক কোনো ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা উল্লেখ করেনি। প্রতিবেদন তৈরিতে অযথা সময় নষ্ট করেছে, কমিশনকে অসম্মান করেছে, অতিরিক্ত সময় নিয়েও বিভ্রান্তিকর তথ্যে ভরা প্রতিবেদন দিয়েছে এবং বায়োমেট্রিকস ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে মোবাইল ফোন গ্রাহক নিবন্ধনের বিশাল এবং প্রশংসিত প্রক্রিয়ার দুর্বলতা প্রমাণের অপচেষ্টা করেছে। এ ছাড়া বাংলালিংকের একজন কর্মকর্তা এ বিষয়ে তাঁর ই-মেইলে প্রতিমন্ত্রী সম্পর্কে যে মন্তব্য করেন তা শিষ্টাচারবহির্ভূত। বিটিআরসির সভায় ওই কর্মকর্তাকে সতর্ক করার জন্য বিটিআরসিতে দুই মাসের জন্য অবাঞ্ছিত ঘোষণা করারও সুপারিশ করা হয়।

রবি ও বাংলালিংক প্রসঙ্গে কার্যপত্রে শাস্তির প্রস্তাব করে বলা হয়, অপারেটর দুটি তাদের প্রতি ইস্যুকৃত ৩জি লাইসেন্সিং গাইডলাইনের অনুচ্ছেদ-৪৯ এবং ৪-জি লাইসেন্সিং গাইডলাইনের অনুচ্ছেদ-৩৭-এর শর্তাবলি লঙ্ঘন করেছে।

এদিকে গত অক্টোবরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ করপোরেট সিম বাইরে বিক্রির অভিযোগে গ্রামীণফোনের এক বিপণন কর্মকর্তা ও একজন পরিবেশককে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। ওই সময় জানা যায়, কালোবাজারে বিভিন্ন নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের নামে ইস্যুকৃত এসব করপোরেট সিম উচ্চমূল্যে জঙ্গি, চাঁদাবাজ, অপহরণকারী, সন্ত্রাসীদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। যার কারণে প্রায়ই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ধরনের সিম ব্যবহারকারীদের সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারে না। এর ফলে বিভিন্ন অপরাধের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হচ্ছে। এ অবস্থা নিয়ন্ত্রণে বিটিআরসি গত ফেব্রুয়ারিতে করপোরেট গ্রাহকদের জন্য সিম উত্তোলন, প্রতিস্থাপন, হস্তান্তর ও নিষ্ক্রিয়করণের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের প্রধানের জাতীয় পরিচয়পত্র ও আঙুলের ছাপ নেওয়া বাধ্যতামূলক করে নির্দেশনা জারি করে।

যোগাযোগ করা হলে রবির মিডিয়া, কমিউনিকেশন অ্যান্ড সাস্টেইনেবিলিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ইকরাম কবীর কালের কণ্ঠকে ই-মেইলে লিখিত বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘বিটিআরসি থেকে আমরা এখনো কোনো ধরনের চিঠি পাইনি এবং কোনো ধরনের জরিমানার কথাও আমাদের জানা নেই। এ বিষয়ে জানার পর আমাদের মন্তব্য করা সম্ভব হবে।’

তবে বিষয়টি নিয়ে রবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বিটিআরসিকে ই-মেইলে যে জবাব দিয়েছেন এবং জরিমানা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার প্রমাণ কালের কণ্ঠ’র কাছে রয়েছে।

বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান বলেন, ‘কিছু প্রতারক রয়েছে তারা ভালো নম্বরগুলো প্রতারণার মাধ্যমে উঠিয়ে নিয়ে অন্য গ্রাহকের কাছে বেচে দেয়। এটাই সমস্যা।’ তিনি কালের কণ্ঠকে আরো বলেন, প্রতিমন্ত্রী, শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নম্বর এরই মধ্যে ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি এবং বিটিআরসির সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা চলছে।

এ বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার বিটিআরসির সিস্টেম অ্যান্ড সার্ভিস বিভাগের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজিজুর রহমান সিদ্দিকী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের বিভিন্ন বিভাগের সমন্বয়ে রবি ও বাংলালিংককে প্রশাসনিক জরিমানার পরিমাণ নির্ধারণের কাজ শুরু হয়েছে। এ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর তা বিটিআরসির সভায় উপস্থাপন করা হবে। এরপর লাইসেন্সিং ও লিগ্যাল বিভাগের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ তিনি আরো বলেন, বাংলালিংকের স্বীকারোক্তি মতে এই অপকর্মে তাদের ১২ জন প্রতিনিধির যোগসাজশ ছিল। ওই ১২ জনের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা জানতে চেয়ে গত ২৭ মার্চ বাংলালিংককে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

যোগাযোগ করা হলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. শহিদুল ইসলাম গতকাল মঙ্গলবার রাতে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলালিংকের গ্রাহক হিসেবে আমার নম্বরটি দীর্ঘদিন ধরে আমি ব্যবহার করে আসছিলাম। এ নম্বরটি আমার নামে বায়োমেট্রিকস ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে নিবন্ধনও করা আছে। কিন্তু দেশে এমএনপি সেবা চালু হওয়ার পর হঠাৎ করে এটি বন্ধ হয়ে যায়। পরে জানতে পারি আমার নম্বরটি অন্য গ্রাহকের নামে গ্রামীণফোনে পোর্টিং করা হয়েছে। এরপর এ বিষয়ে আমি বিটিআরসির কাছে অভিযোগ করি।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here